এশিয়া মহাদেশভুক্ত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ নিজেদের প্রজা ভাবে; সরকারপ্রধান, রাষ্ট্রপ্রধান, মন্ত্রী-এমপিদের মোটাদাগে রাজা, উজির গণ্য করে। পৃথিবীর মধ্যে আনুপাতিক হারে আয়তনে ক্ষুদ্র বাংলাদেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রেমপ্রীতি, সহানুভূতি, সংবেদনশীলতা উন্নত দেশের সাধারণ জনগোষ্ঠী অপেক্ষা অনেক বেশি ও ইতিবাচক। বিশেষ করে গ্রামীণ জনগণ সাদামানুষ হিসেবে সরলীকরণ, আবদার-অভিযোগ করে, স্বল্পতে তুষ্ট হয়, সরল-ষড়যন্ত্রমুক্ত কথা বলে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সময় বিভিন্ন জরিপে দেখানো হচ্ছে, তারা ভোট দিতে অনাগ্রহী; জরিপ অসত্য নয়। বাস্তবতা হচ্ছে সাদা-সরল মানুষগুলোর চাহিদা মোটা ভাত, মোটা কাপড়, যা বর্তমানে বাংলাদেশের এনজিওগুলোর সুবাদে পাচ্ছে। প্রত্যন্ত গ্রামে তাদের হাতে টাকাপয়সা যাচ্ছে, মানি সার্কুলেশন হচ্ছে। তারা জুতা স্যান্ডেল, মামুলি পোশাকপরিচ্ছদ পরছে, আংরা-ছাই-চুলার মাটির পরিবর্তে টুথপেস্ট ব্যবহার করছে। ফলে মাঝারি, বড় শিল্প গড়ে উঠছে, সচেতন হচ্ছে। আত্মকর্মসংস্থানের মাধ্যমে তাদের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়ন হচ্ছে। তাই তো তারা চায়ের স্টলে, টেম্পু স্ট্যান্ডে সজোরেই বলছে, ‘রাজার সুখে প্রজার সুখ, রাজার দুঃখে প্রজার দুঃখ।’ তাই রাজাকে তারা সুখী দেখতে চায়। বিগত সরকারের দেড় দশক বিরোধী দলকে বোতলবন্দি করে সরকার দেশ শাসন করায় আজ তারা ফ্যাসিস্ট উপাধি পেয়েছে। বর্তমানেও দেশ দিশাহারা। অনেক জনসমর্থিত রাজনৈতিক দল যদি আবার বোতলবন্দি হয়, স্পার্কলিং ওয়াটারের মতো কোন্ সময় যে আবার বোতলের কর্ক ফেটে যাবে। সেই বিস্ফোরিত তরল ছড়িয়ে পড়বে, মানুষ অশান্তিতে নিমজ্জিত হবে, দেশ আবারও খাদের কিনারে গিয়ে দাঁড়াবে ইত্যাদি নিরপেক্ষ নির্মোহ, লাগসই জুতসই রাজনৈতিক আওয়াজ রাজাদের কানে পৌঁছানো দরকার। সোনার বাংলার সফলতা আনার জন্য ঐক্যের বিকল্প নাই। দেশের রাজনীতিবিদ, উন্নয়ন অ্যাকটিভিস্ট, আমলা, সুশীল, শিল্পপতি, ধনাঢ্য ব্যক্তি তাদের চিকিৎসা-শিক্ষা বাংলাদেশের বাইরে না করার বিধান বহাল করলে, নিজেদের ছেলেমেয়ে এবং রোগীদের দেশের সেবা কেন্দ্রে দেখতে গিয়ে সাধারণ জনগণের অসাধারণ অভিমত শুনতে পারতেন। দেশের পদস্থ নাগরিকদের হাতকড়া লাগিয়ে হাজতে, বিচারালয়ে আনা-নেওয়ার চিত্র দেখে সাধারণ মানুষের চোখে পানি দেখেছি। কেউ কেউ বলেছেন, ‘আমরা-তো অত মানি লোক না। মানি লোকের অপমান মানতে পারছি না। মানির সম্মান না থাকলে আমরা সাধারণ নাগরিক তো গণনার মধ্যেই নাই।’
প্রিয় পাঠক, টিএমএসএস-এর জন্মকালীন সভ্য নূরজাহান বেগম সপ্তাহের সোম ও বৃহস্পতিবার রোজা রাখতেন। তাঁর শিরদাঁড়া বাঁকা হয়ে গেছে। তারপর বুধবারেও রোজা রাখতেন। টিএমএসএস মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের ডাক্তার তাঁকে স্বাস্থ্যসচেতনভাবে চলতে বলেছেন। এক বুধবারে নাশতা খাওয়ার সময় তিনি বলছেন, ‘আমি রোজা রেখেছি’। জিজ্ঞাসা করায় বললেন, ‘বেগম খালেদা জিয়া যেন জেলে না যায় সেজন্য রোজা রেখেছি।’ তারপর তিনি বললেন, ‘কোনো পরিবারের সক্ষম, উপার্জনশীল উত্তম পিতা-মাতা অর্থাৎ স্বামী-স্ত্রী যখন দারুণ ঝগড়া করে, একে অপরের প্রতি আক্রমণাত্মক হয়, আহত করে তখন ওই পরিবারের সব ছেলেমেয়ে, পিতা-মাতা, শ্বশুর-শাশুড়ি, ওই দম্পতির সহোদর ভ্রাতা-ভগনির যে কষ্ট হয়, অশান্তি হয়, খালেদা জিয়া এবং শেখ হাসিনার দ্বন্দ্বে দেশের মানুষের সে-তুল্য কষ্ট হয়।’ আমি জিজ্ঞাসা করলাম, দুজনই তো নারী, কে স্বামী, কে স্ত্রী? নূরজাহান বেগম বললেন, ‘যিনি সরকারে থাকেন তিনি স্বামী, আর বিরোধী দলের জন স্ত্রী।’ আমি বললাম, স্বামী-স্ত্রীর অধিকার সমান, আপনি তো স্ত্রীকে ক্ষমতাহীন করলেন? উত্তরে তিনি বললেন, ‘আমি তো আমার ভাবনার কথা বললাম, আপনার ভাবনা আপনি ভাবেন।’ তারপর আমি বললাম, বিরোধী দল তো খালেদা জিয়া নয়, বিরোধী দল জাতীয় পার্টি। তিনি বললেন, ‘এটা তো পুথিতে আছে, জনতার কাছে না। জনতার জবানে বিএনপিই বিরোধী দল।’
বিগত ১৫ বছর বিএনপি, জামায়াতসহ সব বিরোধী দলকে বোতলবন্দি রেখে সরকার চালানোর ফলে ৩৬ জুলাই হলো, দেশের অনেক সম্ভাবনাময় ব্যক্তিদের জলাঞ্জলি হলো, বিদেশে বিভিন্ন সেমিনার, সিম্পোজিয়ামে সমালোচনার বাণী শুনতে হচ্ছে। ৩৬ জুলাইয়ে হাজার হাজার মানুষের আত্মত্যাগের আকাক্সক্ষা, এ দেশে যেন কখনোই কোনো শাসক ফ্যাসিস্ট হয়ে উঠতে না পারে। তাই আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী যুবসমাজের আকাক্সক্ষা নিছক আবদার নয়, আবশ্যিক। এজন্য ঐকমত্য কমিশনের যে ১০টি ইস্যুতে বিএনপি নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে, এই ১০টি কমে নিয়ে এনসিপি, জামায়াতসহ সব ইসলামী দলকে আস্থায় নেওয়ার আবেদন সাধারণ মানুষের পক্ষ থেকে আছে। তেমনি দেশের সংসদের উচ্চকক্ষতে পিআর পদ্ধতি বিএনপি মেনে নিলে নিম্নকক্ষ পূর্ব চলমান পদ্ধতি মেনে নেওয়ার জন্য এনসিপি, জামায়াতসহ সব ইসলামি দলের প্রতি আবেদন আছে। সর্বোপরি, জনগণের আবেদন রাজনৈতিক ঐক্য। দেশের রাজনীতি ভালো না থাকলে জনগণ ভালো থাকবে না। তাই জনগণ সচেতনভাবেই ভোট কেন্দ্রে উপস্থিত, অনুপস্থিত, ‘হ্যাঁ ভোট’, ‘না ভোট’ দেবে। ক্ষমতাধর বিত্তবৈভবের মালিকদের অনেক কিছু সামাল দিতে হয়। যার মধ্যে বিনোদনবিহীন বিদ্বেষ, জীবনঝুঁকির বিদ্বেষ বহন করতে হয়, ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমাতে হয়।
সব ধর্ম ও সভ্যতামতে বয়জ্যেষ্ঠদের সম্মান দেওয়া, মান্য করার তাগিদ আছে। কারণ পৃথিবী, প্রকৃতি থেকে তারা কিছু সময়ের জ্যেষ্ঠতার কারণে অভিজ্ঞতা শিক্ষা নেওয়ার সুযোগ পেয়েছে। তাদের টেকসই জ্ঞান বেশি হিসেবে গণ্য করা হয়। তাদের মর্যাদা না দেওয়া, বেয়াদবি করলে সৃষ্টিকর্তার রহমত থেকে বঞ্চিত হতে হয়। তাই এনসিপি কনিষ্ঠ পার্টি হিসেবে জ্যেষ্ঠ পার্টি এবং ব্যক্তিদের সম্মান দিয়ে চলবে, সাধারণ মানুষের এই প্রত্যাশা। আবারও বলছি, জাতীয় ঐক্য না থাকলে জাতীয় উন্নয়ন ব্যাহত হবে ও হচ্ছে। ফলে দেশের বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান, উৎপাদন, আয় এ-জাতীয় সহায়ক বিষয়গুলো বৃদ্ধি পাচ্ছে না বরং হ্রাস হচ্ছে। ব্যয় ও ঋণের বোঝা অসহিষ্ণুতা, অন্যায় ও অশান্তির ফলে গণবিস্ফোরণ-বিপ্লব পরিস্থিতি দেশের মানুষকে ভোগাবে। দেশের সাধারণ জনগণের সহ্যের সীমা শেষ হবে না, জাতীয় মুরব্বিদের মসিবত হবে।
বর্তমানে দেশের সাধারণ মানুষ বিরোধ-বিদ্বেষ নামক বিপর্যয় থেকে অনেকটা মুক্ত, করোনাকালে যেমন তারা সংক্রমণমুক্ত ছিল। টিএমএসএস মেডিকেল কলেজ ১ হাজার শয্যাবিশিষ্ট বেসরকারি হাসপাতালে করোনার চিকিৎসায় সমগ্র দেশের মধ্যে সফল থাকার নিমিত্তে আমি আমাদের কৃষিভিত্তিক কায়িক (এলসিএস) শ্রমিকদের অবস্থা-অবস্থান ছাড়াও নিথর পৃথিবীর নিথর বাংলাদেশে আমার গাড়িতে করে ফেস মাস্কের কার্টন নিয়ে গ্রামে গিয়ে তাদের করোনার কথা জিজ্ঞাসা করলে কেউ কেউ বলতেন, ‘ওষুধ কোম্পানির ওষুধ বেচার জন্য এগুলো ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে। আমাদের দি-হাটে (এলাকা) করোনা নাই। সর্দি-জ্বর আগেও ছিল এখনো আছে। বুকে-নাকে সরিষার তেল দিয়ে রোদে থেকে গোসল দিলেই সেরে যায়, করোনা-টরোনা দেখি না। যাদের টাকাপয়সা আছে তাদের এগুলো ব্যারাম। আমাদের পরিশ্রমী শরীরে ব্যারাম ধরার সুযোগ নাই।’ তাদের মনোবলে বলীয়ান হয়ে আসতাম ঠিক-ই, রাতে শোবার পর কলিংবেল, ফোনের ঝনঝনানি, গেটে শব্দ করে বাড়ি দেওয়ার কারণ অনুসন্ধানে শুনতাম, হাসপাতাল থেকে টাকাওয়ালাদের অক্সিজেন দেওয়া হচ্ছে, অন্যদের অবহেলা করা হচ্ছে! হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ চিকিৎসককে জিজ্ঞেস করায় তারা বলছিলেন, অক্সিজেনের সিলিন্ডারবাহী ট্রাক রাস্তা নির্মাণজনিত খানাখন্দের মধ্যে পড়ে বিকল হওয়ায় সিলিন্ডারের কমতিতে ঝুঁকিপূর্ণ রোগীকেই অক্সিজেন দেওয়া হচ্ছে, ধনী-দরিদ্র গণ্যে নয়।
প্রিয় পাঠক, টিএমএসএস হেলথ সেক্টরের নির্বাহী উপদেষ্টা প্রফেসর ডা. মওদুদ হোসেন আলমগীর পাভেলের ট্রিটমেন্ট প্রটোকল পরিকল্পনা মোতাবেক সুরক্ষা কৌশলে টিএমএসএস মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে হাজার হাজার করোনা রোগীর চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। তার মধ্যে মৃত্যুর সারিতে কোনো গরিব রোগী ছিল না। কথিত ধনী রোগীর মধ্যে বীর মুক্তিযোদ্ধা মোফাজ্জল হোসেন, প্রফেসর ডা. মাসুদুর রহমান, মৃত্তিকাসম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট, বগুড়ার প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা শাহ মো. গোলাম মওলা, আমার বড় ভাশুর মিরাজ উদ্দিন তালুকদারের স্ত্রী (জায়েদা বেগম), আমার গর্ভধারিণী মায়ের (জোবেদা বেওয়া) মৃত্যু ছাড়া সবাই আরোগ্য লাভ করেছে, করোনামুক্ত হয়েছে। অক্সিজেনের অভাবে হাসপাতালে হুলস্থুল বিভীষিকাময় অবস্থা অনুধাবন করে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক, এইচএসবিসি ব্যাংক, রোটারি ক্লাব অব ঢাকা, রমনা-এর সহায়তায় বিশাল অক্সিজেন প্ল্যান্ট স্থাপন করা হয়েছে। অক্সিজেনের স্বয়ংক্রিয় সরবরাহ লাইন সাধারণ হাসপাতাল, ক্যানসার হাসপাতাল সর্বত্র সবলভাবে সরবরাহ করে চিকিৎসাসেবার অত্যাধুনিক পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে। এ ছাড়াও সিলিন্ডারের অক্সিজেন নিকটবর্তী হাসপাতাল-ক্লিনিকে সরবরাহ করা হচ্ছে। অত্র হাসপাতাল চত্বরে দেশখ্যাত ল্যাব, বিশ্বখ্যাত বায়োমলিকুলার ল্যাব দ্বারা দুরারোগ্য রোগের উপসর্গ অনুভবের বহু আগেই ক্যানসারের সংক্রমণ আগাম শনাক্তকরণ ইত্যাদি সফিস্টিকেটেড আইএসও ১৫১৮৯:২০২২ সার্টিফায়েডযুক্ত সেবার সুযোগে দেশবিদেশের বিশেষায়িত জ্যেষ্ঠ প্রফেসর-ডাক্তারদের বিসিএল অ্যাভিয়েশন কোম্পানি স্থাপন করে দুইটি হেলিকপ্টারে আনা-নেওয়ার মাধ্যমে উন্নত চিকিৎসা নিশ্চিত করা হচ্ছে। বেসরকারি সংস্থা অর্থাৎ নন-গভর্নম্যান্ট অরগানাইজেশন (এনজিও) কর্তৃক গ্রামগঞ্জে সেবাকাজ তথা সফল বাস্তবায়নের কাজ করিয়ে নিলে গভর্নম্যান্ট অরগানাইজেশন (জিও) সজোরে রেগুলেশন/অভিভাবকত্ব করতে পারবে। দেশের অবস্থার উন্নয়ন হবে। জিও মানেই রাজা, গজা, আমির, আমলা। তাদের সুখেই প্রজা সুখী, তাদের দুঃখে প্রজা দুঃখী। তাই ‘রাজার সুখেই প্রজার সুখ’ প্রবাদটি বাস্তবায়নের জন্য প্রতিশোধপরায়ণতা বন্ধ করতে হবে, উদার, উন্মুক্ত হতে হবে। নচেৎ বারবার সংঘাত, বিপ্লব তেড়ে আসবে। সাধু সাবধান।
লেখক : প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক, টিএমএসএস
ইমেইল : [email protected]