জনজীবনে প্রযুক্তির ব্যবহার ক্রমাগতই বাড়ছে। বিশেষ করে ডিভাইসকেন্দ্রিক টেলি কমিউনিকেশন্স। পড়াশোনা না জানা মানুষও এই প্রযুক্তির ব্যবহার সম্পর্কে অবগত। প্রায় সবার কাছেই প্রযুক্তি যাপিত জীবনের প্রাণাধিক প্রিয় অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে। তাতে বাদ দিয়ে যেন চলে না জীবন, পরিবার, সমাজ এমনকি রাষ্ট্র। কারণ এই প্রযুক্তি হয়ে উঠতে পারে জীবন বাঁচানোর অন্যতম সূচনাপথ। ধরুন ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়েতে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় রক্তাক্ত এক যুবক পড়ে আছে রাজপথে। অনেকেই দিগি¦দিক দিশাহারা। এমনকি স্বজনরাও ভেবে উঠতে পারছে না কী করবে। ঠিক সে মুহূর্তে মুঠোফোন থেকে যদি কেউ ৯৯৯-এ কল করেন। তৎক্ষণাৎ অভাবিত ঘটনা ঘটতে পারে। বিস্ময়ের ঘোর কাটার আগেই স্পটে পুলিশ ও অ্যাম্বুলেন্সের ত্বরিত গতিতে হাজির হয়ে যাবে। আহত ব্যক্তিকে সময়মতো হাসপাতালে নেওয়া মানে তার জীবন বেঁচে যাওয়া। মনে রাখতে হবে, ঘটনাস্থলে উল্কাবেগে অ্যাম্বুলেন্স আসার নেপথ্যে কাজ করছে একটি বিশেষ সংস্থার প্রযুক্তি। যারা অবগত, তারা সহজেই বুঝে গেছেন এই প্রযুক্তির কথা। এই সেবার মূলে রয়েছে ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি)। তারাই ২৪ ঘণ্টা সারা দেশে সার্ভিলেন্সে সম্পৃক্ত রয়েছে। পরিষেবা প্রার্থিত ব্যক্তির কল করতে দেরি; কিন্তু তাদের কর্মকাণ্ডের গতি ৫-জির মতো। এনটিএমসির ‘জিও লোকেশন সার্ভিস’ নাগরিকদের যে কোনো সংকট থেকে দ্রুততম সময়ে পরিত্রাণ নিশ্চিত করে। প্রযুক্তির এই বটবৃক্ষ কেবল জরুরি পরিষেবায় নয়, দেশের নিরাপত্তা রক্ষায় অবিরাম ছায়া দিয়ে যাচ্ছে সতর্কভাবে।
ধরে নিন, একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী রাজধানীসহ সারা দেশে বোমা হামলার গোপন ষড়যন্ত্র করছে। যত ঘনিয়ে আসছে নির্বাচন, এই ধরনের হামলা ষড়যন্ত্রের আশঙ্কা বাড়ছে। এই শঙ্কা থেকে দেশকে নিরাপদ রাখতে এনটিএমসির ফোন ট্র্যাকিং প্রযুক্তি হয়ে উঠতে পারে রক্ষাকবচ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এনটিএমসির এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে মুহূর্তেই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে চিহ্নিত করে তাদের পরিকল্পনা নস্যাৎ করে দিতে পারে। ফলে আশঙ্কার ভয়াবহতা থেকে অনেকাংশেই রোধ করা সম্ভব। দেশরক্ষায় প্রযুক্তি ও সংস্থাগুলোর প্রয়োজন অনস্বীকার্য, তবে তা অবশ্যই নীতি ও নৈতিকতার শৃঙ্খলায় বাধা থাকতে হবে। বিচারিক অনুমোদনের তীক্ষè নজরদারিতেই কেবল এর কার্যকারিতা অক্ষুণ্ন রাখার বিষয়টি নিশ্চিত রাখতে হবে। প্রযুক্তির অপব্যবহারের এক ভয়াবহ উদাহরণ হলো ভিওআইপি জালিয়াতি। যা হয়তো অনেকের কাছে ‘সস্তায় বিদেশ থেকে কথা বলার সহজ মাধ্যম’ হলেও এটি মূলত এক নীরব অর্থনৈতিক ঘাতক। এই অপরাধের মাধ্যমে দেশ বছরে হাজার হাজার কোটি টাকার রাজস্ব হারায়। অর্থনীতি ছাড়াও এই প্রযুক্তি জাতীয় নিরাপত্তার জন্যও এক মারাত্মক হুমকি। বিদেশ থেকে অপরাধীরা মানব পাচার, সাইবার প্রতারণা, জঙ্গি যোগাযোগ ও রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্রের ক্ষেত্রে ভিওআইপি ব্যবহার করে। দৃশ্যত র্যাব, পুলিশ ও বিটিআরসি নিয়মিত অভিযান চালালেও পর্দার আড়ালে যে প্রতিষ্ঠানটি প্রযুক্তির আলো ফেলে অপরাধীদের ব্যবহৃত অবৈধ ফোন নম্বর ও তাদের অবস্থান চিহ্নিত করে, সেটিও এনটিএমসি। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে সামাজিক মাধ্যমে যেসব মিথ্যা-গুজব বিভ্রান্তি ছড়ানো হয়, তা শনাক্ত ও চিহ্নিত করার পেছনেও মুখ্য ভূমিকায় রয়েছে এনটিএমসি। গুজবের উৎস বাতলে দেওয়া থেকে শুরু করে বিটিআরসির সহায়তায় তা অপসারণ, সব ক্ষেত্রে সরকারের এই প্রতিষ্ঠানটি নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে। সব মিলিয়ে এনটিএমসি হলো আইনপ্রয়োগকারী, তদন্তকারী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর জন্য একটি ‘জাতীয় নিরাপত্তার অবিকল্প আর্কাইভ’। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিগত সমর্থন দেওয়াই এই প্রতিষ্ঠানের মূল কাজ।
পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতেও এমন একক সংস্থা অত্যাধুনিক প্রযুক্তিকে কার্যকরভাবে ব্যবহার করে। যেখানেই সন্দেহের তির, সেখানেই এনটিএমসির আইনি চোখ। তবে জনসমক্ষে এনটিএমসি তার প্রযুক্তিগত কৌশল উন্মোচন করে না। কারণ তাতে অপরাধীরা সতর্ক হয়ে যেতে পারে। অন্যান্য দেশের একই উদ্দেশ্যে গঠিত সংস্থাগুলোও একই কারণে প্রকাশ্যে আসে না। এনটিএমসির এই অপ্রকাশ্য রূপ মানে কোনো দুর্বলতা নয়, এটি জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষার এক সুচিন্তিত কৌশল, যা দেশের চারপাশে এক অভাবিত সুরক্ষাবলয় তৈরি করে।
এনটিএমসিকে ঘিরে হাজারো অভিযোগের মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক অভিযোগটি হলো, মানুষের ব্যক্তিগত গোপনীয়তার (প্রাইভেসি) দেয়াল ভেঙে প্রবেশ করা। অথচ বাস্তব চিত্র ভিন্ন। এই সংস্থা অযাচিতভাবে ব্যক্তিগত ফোনালাপ শোনে না বা রেকর্ড করে না। বরং তারা কাজ করে জাতীয় নিরাপত্তার বৃহত্তর স্বার্থে, আইনি শৃঙ্খলা নিশ্চিত ও নিরাপদ রাখতে। কেবল তদন্তের স্বার্থে আইনপ্রয়োগকারী, তদন্তকারী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এনটিএমসির সিস্টেম ব্যবহার করে সন্দেহভাজন অপরাধীদের ওপর নজরদারি করে। নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এটি এক অপরিহার্য অংশ। এই প্রযুক্তিগত অস্ত্র ছাড়া আজকের দিনে স্মার্ট ও জটিল অপরাধের মোকাবিলা করা কঠিন হয়ে পড়বে।
এনটিএমসি-এর সিকিউরিটি অপারেশনস সেন্টারে রয়েছে একটি শক্তিশালী সাইবার সিকিউরিটি দুর্গ। যেখানে ৭ স্তরের ডেটা প্রটেকশনের মতো বিশ্বমানের নিরাপত্তা ব্যবস্থা চালু রয়েছে। শুধু নজরদারির প্রতিষ্ঠান নয়, এনটিএমসি প্রমাণ করছে- বাংলাদেশও এখন বিশ্বমানের নিরাপত্তা প্রযুক্তি ব্যবহারে পিছিয়ে নেই। আশঙ্কার চাদর সরিয়ে সত্যি উদ্ঘাটনের পথ নির্মাণ করে বিশ্বাস ও আস্থা অজনের পথ বেয়ে আজ এনটিএমসি গৌরবময় প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানকে বাদ দিয়ে জাতীয় নিরাপত্তার অখণ্ডতা কল্পনা করা যায় না। পরিবার ও রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি। আমরা কোনোভাবেই চাই না দেশে নতুন করে কোনো ফ্যাসিস্ট বা জঙ্গি হামলা হোক। আবার এটাও নিশ্চিত হওয়া উচিত নির্দোষ কেউ যেন হয়রানির শিকার না হয়। আমরা সবাই চাই প্রযুক্তি থাকুক, তা অবশ্যই নীতির শৃঙ্খলায় বাধা। তবে সমালোচনার সুযোগও সেখানে থাকতে হবে। অতীতে প্রযুক্তির অপব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে। সেই অনভিপ্রেত ভুল থেকে শিক্ষা নিতে হবে। অতীতে গুরুত্বপূর্ণ এই প্রযুক্তির অপব্যবহারের কালো ধোঁয়া এখনো এদেশের মুক্ত-নির্মল বাতাসে বারুদের গন্ধ ছড়িয়ে রেখেছে। কিন্তু আর নয়। আজ সুযোগ এসেছে এনটিএমসির সামনে সব কিছু ঝেড়ে ফেলে স্বচ্ছতা, নৈতিকতা এবং জবাবদিহির এক ইস্পাতকঠিন সংস্কৃতির বলয় সৃষ্টি করার। ‘সবার আগে দেশ’- এই স্লোগানে প্রোজ্জ্বল থেকে প্রযুক্তিনির্ভর সুরক্ষিত মাতৃভূমি গড়ে তুলতে শতভাগ সততা এবং নিষ্ঠা নিশ্চিত করা জরুরি।
লেখক : তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ