স্বাস্থ্য খাতের মাফিয়া মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠুর বড় ভাই মো. মোকছেদুল ইসলাম। মো. মোকছেদুল ইসলামের রয়েছে পাঁচটি প্রতিষ্ঠান। রংপুর সিভিল সার্জন কার্যালয়ের অধীনে মোকছেদুলের কিউ সোর্স ২০১৩ সাল থেকে তিন অর্থবছরে ৫০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে। মিঠুর মূল প্রতিষ্ঠানের নাম লেক্সিকোন মার্চেন্ডাইজ। এর বাইরে তাঁর নামে-বেনামে রয়েছে আরও ৬০ প্রতিষ্ঠান। এভাবে ২০ বছরের বেশি সময় মিঠু জিম্মি করে রাখেন দেশের স্বাস্থ্য খাত।
এ ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা আছে মিঠুর স্ত্রী নিশাত ফারজানা, ভাগনে মো. ফাহাদ মাহমুদ এবং মিঠুর ভাবি সাবিহাতুল জান্নাতের। এ চক্র নানান প্রতিষ্ঠানের ভুয়া বিল-ভাউচার বানিয়ে বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের কিছু কর্মকর্তার যোগসাজশে হাতিয়ে নিয়েছে শত শত কোটি টাকা। স্বাস্থ্য খাতে সিন্ডিকেট করে বিপুল অর্থ আত্মসাৎ ও পাচারে জড়িত থাকার অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলায় গত বৃহস্পতিবার গ্রেপ্তার করা হয়েছে মোতাজ্জেরুল ইসলাম ওরফে মিঠুকে। কিন্তু এখনো অধরা মিঠু সিন্ডিকেটের চার কুশীলব এবং এ চক্রে জড়িত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তরসহ অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত অসাধু কর্মকর্তারা। এ ব্যাপারে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘এ ধরনের বহুমাত্রিক দুর্নীতি কেউ একা করতে পারে না। এর সঙ্গে যোগসাজশে, সহায়তায় এবং সুরক্ষা দেওয়ার জন্য অনেকেই রয়েছেন। তাই শুধু একজনকে গ্রেপ্তার করলে হবে না, এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট স্বজন, সরকারি প্রতিষ্ঠানের কোন কোন কর্মকর্তা জড়িত ছিলেন সেগুলো তদন্ত করতে হবে। আমরা চাইব পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত মূল অপরাধীর সহযোগীদেরও আইনের আওতায় আনা হবে।’
অনুসন্ধানে জানা গেছে, মিঠুর প্রতিষ্ঠান ২০০৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহের কার্যাদেশ পায়। কার্যাদেশপ্রাপ্ত হয়ে মালপত্র সরবরাহ না করে সরকারি প্রতিষ্ঠানের কয়েক হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করে। এ টাকার বড় অংশই বিদেশে পাচার করেন তিনি। ২০০৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত লেক্সিকোন মার্চেন্ডাইজ এবং টেকনোক্রেট লিমিটেড নামে দুটি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে স্বাস্থ্য খাতে প্রায় ৯০ শতাংশ যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা হয়। একটি সরকারি সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়, মুগদা জেনারেল হাসপাতালে ২০১৬-১৭ পর্যন্ত কয়েক বছরে মিঠুর স্ত্রীর ফিউচার ট্রেড ৮৬ কোটি টাকার বেশি কার্যাদেশ পায়। এ থেকে প্রায় ৫৬ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন তিনি। ভাগনে মো. ফাহাদ মাহমুদের অরডেন্ট সিস্টেম ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আত্মসাৎ করে ৪ কোটি টাকা। মিঠুর ভাবি সাবিহাতুল জান্নাতের জিএসই অ্যান্ড ট্রেডিং কয়েক বছরে ৩২ কোটি ৬১ লাখ টাকার কার্যাদেশ থেকে আত্মসাৎ করে প্রায় ২০ কোটি টাকা। রংপুর সিভিল সার্জন কার্যালয়ের অধীনে মোকছেদুলের কিউ সোর্স ২০১৩ থেকে তিন অর্থবছরে ৫০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে। ২০১৪ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত চক্রটি সিএমএসডি থেকে ৭৩ কোটি ৭৪ লাখ টাকার কার্যাদেশ পায়, তাতে ৪২ কোটি ২২ লাখ টাকা আত্মসাৎ করা হয়। এ সময়ে চক্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ভুয়া বিল-ভাউচার বানিয়ে বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের কিছু কর্মকর্তার যোগসাজশে আরও ৩০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
একটি সরকারি সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়, মিঠু ৬১টি আলাদা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সিন্ডিকেট বানিয়ে সব ধরনের কেনাকাটা নিয়ন্ত্রণ করতেন। মিঠুর নিজ নামে আছে আটটি প্রতিষ্ঠান। সেগুলো হলো লেক্সিকোন মার্চেন্ডাইজার, টেকনো ট্রেড, লেক্সিকোন আইটি পার্ক লিমিটেড, মেসার্স টেকনো ট্রেড, মেসার্স টেকনো ফিশিং, মেসার্স প্রি-এক্স, সিআর মার্চেন্ডাইজ, লেক্সিকোন হসপিটালাইট, নর্থ এগ লিমিটেড, নর্থ বেঙ্গল পোলট্রি ফার্ম, অ্যাপল সিরামিক লিমিটেড, মেড ইকুইপ ইঞ্জিনিয়ারিং, ইনভেনচার, টেকনোক্রেট ও এম গেটওয়ে করপোরেশন (যুক্তরাষ্ট্রে নিবন্ধিত)। মিঠুর স্ত্রী নিশাত ফারজানার নামে তিনটি এবং বড় ভাই মো. মোকছেদুল ইসলামের নামে পাঁচটি প্রতিষ্ঠান আছে। এ ছাড়া মিঠুর অন্যান্য ভাই, ভাবি, ভাগনেসহ বন্ধু ও স্বজনদের নামে রয়েছে অসংখ্য ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান। মিঠুর আদিবাস রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার মহিপুর গ্রাম। যদিও সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে তাঁর বর্তমান ঠিকানা হিসেবে ঢাকার গুলশান, বনানী, এলিফ্যান্ট রোড, মালিবাগ, ডিওএইচএস এবং চট্টগ্রামের আগ্রাবাদের সাতটি বাসার তথ্য আছে। কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের (সিএমএসডি) পরিচালক শহীদউল্লাহ ২০২০ সালে করোনায় মারা যাওয়ার আগে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিবকে চিঠি দিয়ে মিঠুর ফিরিস্তি জানান। এরপর তদন্ত শুরু হয়। রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা, দুর্নীতি দমন কমিশনসহ (দুদক) সব প্রতিষ্ঠান নড়েচড়ে বসে। খবর পেয়ে মিঠু চক্রের প্রধান মোতাজ্জেরুল ইসলাম ওরফে মিঠু বিদেশে পাড়ি জমান। মিঠু নিউইয়র্কের কাছে ব্রংসভিল নামে একটি অভিজাত এলাকায় বসবাস করতেন, বেড়াতেন রোলস রয়েসের গাড়িতে। মিঠু দেশে ফিরেছেন এমন তথ্য পেয়ে রাজধানীর গুলশান থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।