জুলাই সনদ বাস্তবায়নের জন্য ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই নভেম্বরে গণভোট আয়োজনের জন্য নির্বাচন কমিশনের কাছে দাবি জানিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। সেই সঙ্গে জোটগতভাবে ভোট করলেও নিজ দলের প্রতীকে নির্বাচন করার বিধান যেন কোনোভাবেই বদলানো না হয়, সেই দাবি তুলে ধরেছে দলটি।
গতকাল প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিনসহ অন্য কমিশনারদের সঙ্গে বৈঠক শেষে এসব দাবির কথা জানান জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার।
জোটে ভোট করলেও নিজ দলের প্রতীকে নির্বাচন করতে হবে-এমন বিধানসংবলিত গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধন অধ্যাদেশে বৃহস্পতিবার চূড়ান্ত অনুমোদন দেয় উপদেষ্টা পরিষদ। তবে এ বিধান নিয়ে আপত্তি তুলে জোটভুক্ত যে কোনো দলের প্রতীকে ভোট করার বিদ্যমান নিয়ম বহাল রাখার দাবি তুলেছে বিএনপি। সেই সঙ্গে দলটি সংসদ নির্বাচন ও গণভোট একসঙ্গে আয়োজনের কথা বলেছে।
জামায়াত নেতা গোলাম পরওয়ার বলেন, ‘ভোটের আগেই বিএনপি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড লঙ্ঘনের মতো আচরণ করছে। কোনোভাবেই আরপিও আর সংশোধন করা যাবে না। নভেম্বরেই গণভোট করতে হবে।’
জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে ইসির সঙ্গে বৈঠকে ১৮ দফা দাবি উত্থাপন করা হয়েছে জানিয়ে জামায়াত সেক্রেটারি জেনারেল বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বৈঠকটি হয়েছে অত্যন্ত খোলামেলা, আন্তরিক ও সৌহার্দপূর্ণ পরিবেশে। প্রতিটি বিষয় নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়েছে। কমিশন আমাদের বক্তব্য মনোযোগ দিয়ে শুনেছে ও কিছু বিষয়ে ব্যাখ্যা দিয়েছে। আমরা তাদের আন্তরিকতা নিয়ে সন্তুষ্ট। আমরা লিখিতভাবে আমাদের ১৮ দফা দিয়েছি, বলেছি এর বাস্তবায়ন ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়।’
মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, ‘১৮ দফার মধ্যে অন্যতম হলো জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট আয়োজন করতে হবে এবং তা নভেম্বরের মধ্যেই সম্পন্ন করতে হবে। কারণ জনগণকে ভোটের আগে জাতীয় সনদে প্রস্তাবিত কাঠামোগত পরিবর্তন সম্পর্কে জানতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘একই দিনে জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট হলে টেকনিক্যাল ও নিরাপত্তাজনিত জটিলতা দেখা দিতে পারে। তাই গণভোট আলাদা সময়ে আয়োজনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।’ গোলাম পরওয়ার বলেন, ‘আরপিও সংশোধন চূড়ান্ত হয়েছে। আমরা ইতোমধ্যে সংশোধিত বিধান মেনে নিয়েছি। এখন আবার পরিবর্তনের দাবি করা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড লঙ্ঘনের সমান। ভোটের চার মাস আগে বিএনপির এ দাবি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য অশনিসংকেত।’
ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা হিসেবে ইসলামী ব্যাংকসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের নিয়ে বিএনপির আপত্তির বিষয়ে মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, ‘যে কোনো দল বা প্রতিষ্ঠানকে রাজনৈতিকভাবে টার্গেট করা অত্যন্ত দুঃখজনক। আমরা এমন নেতিবাচক রাজনীতি চাই না।’
বৈঠকে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এ টি এম মাছুম, রফিকুল ইসলাম খান, এ এইচ এম হামিদুর রহমান আযাদ, মতিউর রহমান আকন্দ, নুরুল ইসলাম বুলবুল, সেলিম উদ্দিন।
জামায়াতের ১৮ দফা দাবি : জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশনে ১৮ দফা দাবি পেশ করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে-জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি প্রদানের লক্ষ্যে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ জারির পরই নভেম্বরে গণভোটের আয়োজন করতে হবে। উপদেষ্টা পরিষদে গৃহীত সর্বশেষ গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ২০ নম্বর অনুচ্ছেদের সর্বশেষ সংশোধনের বিধান বহাল রাখতে হবে। নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনের প্রতিটি স্তরে শতভাগ নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে হবে। নির্বাচনি কাজের জন্য নিযুক্ত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের নিয়োগের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে হবে। সব ভোট কেন্দ্রে সামরিক বাহিনীর পর্যাপ্ত সদস্য নিয়োগ করতে হবে।
এতে আরও বলা হয়, সব ভোট কেন্দ্রের বুথে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করতে হবে। বিগত অবৈধ নির্বাচনগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রশ্নবিদ্ধ ও বিতর্কিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আগামী নির্বাচনে দায়িত্ব দেওয়া যাবে না। শতভাগ লটারির ভিত্তিতে মাঠ পর্যায়ে প্রশাসনিক কর্মকর্তা নিয়োগ দিতে হবে। রিটার্নিং অফিসার এবং সহকারী রিটার্নিং অফিসার হিসেবে নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রশাসনের অফিসারের সঙ্গে সাধ্যমতো নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব কর্মকর্তাদের মধ্যে থেকেও নিরপেক্ষতা বজায় রেখে সৎ, দক্ষ ও অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের নিয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে। সব ভোট কেন্দ্রে নির্বাচনের কমপক্ষে এক সপ্তাহ আগে সামরিক বাহিনী, বিজিবি, র্যাব, পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর অবস্থান নিশ্চিত করতে হবে। নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সব দলের জন্য সমান সুযোগসুবিধা প্রদান নিশ্চিত করে নির্বাচনি মাঠ সমতল করতে হবে। সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা সব অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করতে হবে। এ ছাড়া বিগত ফ্যাসিবাদী সরকারের আমলে দলীয় লোকদের রাজনৈতিক বিবেচনায় দেওয়া অস্ত্রের লাইসেন্স বাতিল করে তা সরকারের কাছে জমা দিতে হবে। নির্বাচনি এলাকাগুলোতে যারা অবৈধ অস্ত্র ব্যবহার করে সন্ত্রাস ও আতঙ্ক সৃষ্টি করে থাকে তাদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনতে হবে।
সুপারিশে বলা হয়, ভোটারদের নির্ভয়ে কেন্দ্রে আসা-যাওয়ার সুবিধার্থে কেন্দ্রের নির্ধারিত এলাকার মধ্যেই শুধু নয়, বরং এর বাইরেও নির্বাচনি এলাকার যে কোনো স্থানে সন্ত্রাসী তৎপরতার খবর পাওয়া গেলে তাৎক্ষণিক তা দমন করতে হবে। স্পষ্ট ছবিসহ ভোটার তালিকা পোলিং এজেন্টদের যথাসময়ে সরবরাহ করতে হবে। নির্বাচনি কাজে নিয়োজিত পোলিং, প্রিসাইডিং অফিসার, আনসার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্মকর্তা-কর্মচারী সবাইকে পোস্টাল ব্যালটের মাধ্যমে তাঁদের ভোট প্রদানের সুযোগ দিতে হবে। প্রবাসী ভোটারদের ভোট প্রদানের পদ্ধতি সহজ করার জন্য ভোটার আইডি কার্ড বা পাসপোর্ট যে কোনো একটির মাধ্যমে ভোট প্রদানের সুযোগ দিতে হবে। রেজিস্টার্ড প্রবাসী ভোটারদের তালিকা রাজনৈতিক দলগুলোকে যৌক্তিক সময়ের মধ্যে সরবরাহ করতে হবে। নির্বাচন পর্যবেক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে তাদের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা ও নিরপেক্ষতা যাচাই করতে হবে। ফ্যাসিস্ট আমলে নিজেদের সুবিধামতো ভোট কেন্দ্র পরিবর্তন করা হয়েছে। তাই অভিযোগ বিবেচনায় নিয়ে সেগুলো এবং ঝুঁকিপূর্ণ ভোট কেন্দ্র পরিবর্তন করতে হবে।