বিশ্বজুড়ে যখন নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার ক্রমেই বাড়ছে, তখন সেই শক্তিকে সঞ্চয় করার টেকসই সমাধান খোঁজা এখন সময়ের দাবি। সূর্য না থাকলে সৌরবিদ্যুৎ বন্ধ, বাতাস না বইলে স্থবির হয় উইন্ড টারবাইন-এই অনিয়মিত সরবরাহ আজ নবায়নযোগ্য শক্তির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এই প্রেক্ষাপটে আবির্ভূত হয়েছে এক অভিনব প্রযুক্তি-‘তরল বায়ু শক্তি সঞ্চয়’ বা Liquid Air Energy Storage (LAES), যা আগামী দিনে জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমিয়ে দিতে পারে নাটকীয়ভাবে। ২০২৬ সালে যুক্তরাজ্যের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের ক্যারিংটন গ্রামে চালু হতে যাচ্ছে বিশ্বের প্রথম বাণিজ্যিক-স্কেলের তরল বায়ু শক্তি সঞ্চয় প্ল্যান্ট। প্রকল্পটির পেছনে রয়েছে ব্রিটিশ কোম্পানি হাইভিউ পাওয়ার, যারা বিশ্বাস করে, এই প্রযুক্তি এক দিন গ্রিড-স্কেলের লিথিয়াম ব্যাটারি ও পাম্পড জলবিদ্যুতের সঙ্গে পাল্লা দেবে। তাদের আশা, এটি হবে ভবিষ্যতের পরিচ্ছন্ন শক্তি সংরক্ষণের নির্ভরযোগ্য সমাধান।
এই প্রযুক্তি কীভাবে কাজ করে
তরল বায়ু শক্তি সঞ্চয়ের মূলনীতি চমৎকার। প্রথমে, আশপাশের বাতাস সংগ্রহ করে তা থেকে আর্দ্রতা ও কার্বন ডাইঅক্সাইড সরিয়ে ফেলা হয়। এরপর বাতাসকে বারবার সংকুচিত করা হয়, যতক্ষণ না এটি অত্যন্ত উচ্চ চাপে পৌঁছে যায়। পরে মাল্টি-স্ট্রিম হিট এক্সচেঞ্জারের মাধ্যমে তাপমাত্রা এতটাই কমানো হয় যে ‘বায়ু’ তরলে পরিণত হয়। এই তরল বায়ু বিশাল ট্যাঙ্কে সংরক্ষণ করা হয়- এক অর্থে এটি ‘বায়ুনির্ভর ব্যাটারি’। যখন বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে যায়, তখন তরল বায়ু গরম করে ফের গ্যাসে রূপান্তরিত করা হয়। এই গ্যাস টারবাইন চালিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে এবং ব্যবহারের পর বাতাসটি আবার নিঃসৃত হয় প্রকৃতিতে। প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণ নির্গমনমুক্ত ও পুনর্ব্যবহারযোগ্য। তবে প্রযুক্তিটির সাফল্যের গোপন রহস্য লুকিয়ে আছে তাপ পুনরুদ্ধার চক্রে। বায়ু সংকোচনের সময় উৎপন্ন তাপ সংরক্ষণ করা হয়, যা পরবর্তী ধাপে তরল বায়ু বাষ্পীভবনের সময় কাজে লাগে। ফলে সিস্টেমের সামগ্রিক দক্ষতা ৬০-৭০% পর্যন্ত পৌঁছায়, যা বড় অগ্রগতি।
ম্যানচেস্টারের মাইলফলক প্রকল্প
হাইভিউ পাওয়ারের ক্যারিংটন প্রকল্প হবে বিশ্বের প্রথম পূর্ণাঙ্গ বাণিজ্যিক-স্কেলের তরল বায়ু সঞ্চয় কেন্দ্র। এটি ৩০০ মেগাওয়াট-ঘণ্টা (MWh) বিদ্যুৎ সংরক্ষণ করতে পারবে, যা প্রায় ৪,৮০,০০০ পরিবারের কয়েক ঘণ্টার বিদ্যুৎ চাহিদা মেটাতে যথেষ্ট। প্রকল্পটি মূলত দুই ধাপে সম্পন্ন হবে।
♦ প্রথম ধাপে, ২০২৬ সালের আগস্টে টারবাইন চালু করে গ্রিডের স্থিতিশীলতা পরীক্ষার কাজ শুরু হবে। এতে গ্রিডের ভারসাম্য রক্ষায় গ্যাসচালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রয়োজনীয়তা অনেকটা কমবে।
♦ দ্বিতীয় ধাপে, ২০২৭ সালে পূর্ণ ক্ষমতায় তরল বায়ু শক্তি সঞ্চয় চালু হবে, যা প্রয়োজনে গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহ করবে।
হাইভিউর প্রধান নির্বাহী রিচার্ড বাটল্যান্ড বলেন, ‘গ্রিড স্থিতিশীল রাখতে গ্যাসচালিত কেন্দ্র চালু করা এখন ব্যয়বহুল; আমাদের প্রযুক্তি সেই ব্যয় অনেকটা কমাতে পারবে।’
অর্থনীতি ও চ্যালেঞ্জ
তরল বায়ুপ্রযুক্তির সবচেয়ে বড় বাধা এর অর্থনৈতিক কার্যকারিতা। ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার শায়লিন সেটেগেনের মতে, ‘এই প্রযুক্তি এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে থাকায় সব অঞ্চলে লাভজনক নয়।’ যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণায় দেখা গেছে, এটি কেবল ফ্লোরিডা ও টেক্সাসে বাণিজ্যিকভাবে টেকসই হতে পারে, বাকি রাজ্যগুলোয় এখনই নয়। তবু সেটেগেন বলেন, ‘এটি খারাপ নয়; বরং প্রযুক্তিটি এখনো পূর্ণ ব্যবহারের পর্যায়ে পৌঁছায়নি।’ নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার যত বাড়বে, দামের ওঠানামা তত বাড়বে, আর তখনই শক্তি সঞ্চয় প্রযুক্তিগুলো বিশেষত তরল বায়ু অর্থনৈতিকভাবে আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে।
বিশ্বজুড়ে প্রসার
ক্যারিংটনের সাফল্য পেলে হাইভিউ পাওয়ার আরও বড় পদক্ষেপ নিতে চায়। স্কটল্যান্ডের হান্টারস্টন এবং লিংকনশায়ারের কিলিংহোমে দুটি বিশাল প্রকল্প ইতোমধ্যে অনুমোদন পায়। এর মধ্যে একটি প্রকল্প ২.৫ গিগাওয়াট-ঘণ্টা (GWh) পর্যন্ত শক্তি সঞ্চয় করতে সক্ষম হবে, যা ক্যারিংটন প্ল্যান্টের প্রায় দশ গুণ। এর বাইরেও জাপান ও অস্ট্রেলিয়ায় বড় প্রকল্পের পরিকল্পনা রয়েছে। কারণ, একবার অবকাঠামো তৈরি হলে প্রযুক্তিটি বাড়ানো সহজ, স্টোরেজ ট্যাঙ্ক সস্তা আর পরিবেশগত প্রভাবও তুলনামূলক অনেক কম।
খরচ-সাশ্রয়ী সম্ভাবনা
তরল বায়ুপ্রযুক্তির অন্যতম বড় আকর্ষণ এর লেভেলাইজড কস্ট অব স্টোরেজ, অর্থাৎ দীর্ঘমেয়াদে প্রতি মেগাওয়াট-ঘণ্টা শক্তি সঞ্চয়ের গড় খরচ। এটি বর্তমানে মাত্র ৪৫ ডলার পর্যন্ত হতে পারে, যেখানে পাম্পড জলবিদ্যুতে খরচ প্রায় ১২০ ডলার এবং লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারিতে ১৭৫ ডলার পর্যন্ত। ফলে এটি হতে পারে ব্যয়সাশ্রয়ী বিকল্প।
ভবিষ্যতের শক্তির চিত্র
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ভবিষ্যতের বিদ্যুৎ গ্রিড একক কোনো প্রযুক্তির ওপর নির্ভর করবে না; বরং ব্যাটারি, জলবিদ্যুৎ ও তরল বায়ু সঞ্চয়ের মিশ্রণে তৈরি হবে এক ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবস্থা। ব্যাটারি দ্রুত শক্তি সরবরাহে দক্ষ, জলবিদ্যুৎ দীর্ঘমেয়াদি সঞ্চয়ে নির্ভরযোগ্য, আর তরল বায়ু এই দুইয়ের মাঝে সেতুবন্ধন রচনা করতে পারে।
জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমাতে গেলে শুধু নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপাদনই যথেষ্ট নয়, তা সঞ্চয় করাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। তরল বায়ুপ্রযুক্তি সেই ফাঁক পূরণ করতে সক্ষম-পরিচ্ছন্ন, নির্ভরযোগ্য ও অর্থনৈতিকভাবে সম্ভাবনাময় সমাধান হিসেবে।
তথ্যসূত্র : বিবিসি