ক্যানসার আক্রান্ত কুড়িগ্রামের শাকিলা বেগম (৪৫)। স্বামী মারা গেছেন পাঁচ বছর আগে। স্কুলপড়ুয়া দুই ছেলেকে নিয়ে তার সংসার। বাসাবাড়িতে কাজ ও দিনমজুরি করে দৈনন্দিন খরচ চালান। তিনি বলেন, ‘তিনজনের ভাত জোগাড় করতেই কষ্ট হয়ে যায় আমার, এর মধ্যে ক্যানসার হয়েছে জানতে পেরে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। ছেলেরা শখ করে একটা গরু পালন করত। ওটা বিক্রি করে ৩৫ হাজার টাকা নিয়ে ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে এসেছি। চিকিৎসক সিটি স্ক্যান করতে বলেছেন। এ হাসপাতালে মেশিন নষ্ট থাকায় ডায়াগনস্টিক সেন্টারে টেস্ট করাতে ১৪ হাজার টাকা লাগল। অন্য আরও টেস্ট, ঢাকায় যাতায়াত, থাকা-খাওয়াতে টাকা প্রায় শেষ। জানি না চিকিৎসা কীভাবে করাব?’ শাকিলার মতো চিকিৎসার খরচ মেটাতে নিঃস্ব হচ্ছেন আরও অনেক রোগী ও তাদের স্বজনরা। চিকিৎসায় বড় অংশের খরচ হয়ে যায় ডায়াগনস্টিক টেস্টের পেছনে। এ অবস্থায় স্বাস্থ্য ব্যয় কমাতে অত্যাবশ্যকীয় ডায়াগনস্টিক পরীক্ষার তালিকা ও মূল্য নির্ধারণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) কারিগরি সহায়তা চেয়েছে সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। তবে শুধু টেস্টের দাম নির্ধারণ নয়, বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের টেস্টের মান নির্ধারণের দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ প্রাইভেট হসপিটাল, ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন। এ ব্যাপারে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত) অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান বলেন, ‘স্বাস্থ্যসেবা পেতে দেশের মানুষ যে অর্থ ব্যয় করে তার প্রায় ৬৪ থেকে ৬৭ শতাংশ খরচ হয় ওষুধ কিনতে এবং ১১ থেকে ১২ শতাংশ ব্যয় হয় বিভিন্ন ধরনের ডায়াগনস্টিক পরীক্ষায়। এতে অনেক পরিবার দারিদ্র্যের দিকে চলে যায়। মানুষের ওপর থেকে চাপ কমাতে তাই সরকারকে এই দুটি খাতে হস্তক্ষেপ করতে হবে। তিনি আরও বলেন, অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের তালিকা প্রণয়ন এবং এর দাম নির্ধারণে একটি প্রক্রিয়া তৈরি করতে সরকার ইতোমধ্যে একটি টাস্কফোর্স গঠন করেছে।’ অধ্যাপক সায়েদুর আরও জানান, ‘প্রথমে আমরা অত্যাবশ্যকীয় ওষুধ, এরপর অত্যাবশ্যকীয় ডায়াগনস্টিক পরীক্ষার তালিকা তৈরি করব। তারপর দাম নির্ধারণ করব। দুই বা তিনটি শ্রেণিতে দাম নির্ধারণ করা হতে পারে।’ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, অত্যাবশ্যকীয় টেস্টের দাম নির্ধারণে সরকারকে সহায়তা করতে সম্প্রতি ঢাকায় এসেছিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (হু) একটি প্রতিনিধিদল। হুর কারিগরি সহযোগিতায় বৈশ্বিক মানের সঙ্গে তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে নির্ধারণ করা হচ্ছে বিভিন্ন টেস্টের দাম। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ প্রাইভেট হসপিটাল, ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ল্যাবএইড গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. এ এম শামীম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ডায়াগনস্টিক টেস্টের শুধু দাম নির্ধারণ করলে হবে না, মানও নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য একটি একক মান নিয়ন্ত্রণ সংস্থার আওতায় সব তথ্য জমা দিয়ে সনদের ব্যবস্থা করতে হবে। সরকার প্রয়োজনে গ্রেডিং করে দাম নির্ধারণ করতে পারে।’ দেশে স্বাস্থ্যসেবার ব্যয় নিয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (বিআইডিএস) ‘ক্যাটাস্ট্রফিক হেলথ শক অ্যান্ড ইমপোভারিশমেন্ট ইন বাংলাদেশ : ইনসাইট ফ্রম এইচআইইএস ২০২২’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। গবেষণায় দেখা যায়, ২০২২ সালে স্বাস্থ্যসেবার ব্যয় বৃদ্ধির কারণে ৬১ লাখ বাংলাদেশি তথা মোট জনসংখ্যার ৩ দশমিক ৭ শতাংশ দারিদ্র্যসীমায় প্রবেশ করেছে। প্রায় ১৮ শতাংশ পরিবার তাদের মোট খরচের ১০ শতাংশের বেশি খরচ করে স্বাস্থ্যসেবার পেছনে। এ ছাড়া ৯ দশমিক ৪৬ শতাংশ পরিবারকে তাদের খাবারের বাইরের ব্যয়ের মধ্যে ৪০ শতাংশ খরচ করতে হয় স্বাস্থ্যসেবার জন্য। রোগীর পকেট থেকে খরচের একটি বড় অংশ চলে যায় ওষুধ কেনা, টেস্টসহ নানা খরচে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আবদুল হামিদ বলেন, ‘বেসরকারি হাসপাতালে সেবার দাম ও মান নির্ধারণ করে সেটা টাঙিয়ে রাখতে হবে। সেগুলোর ক্যাটাগরি অনুযায়ী দাম ঠিক করে দিতে হবে। এতে রোগী তার সামর্থ্য অনুযায়ী সেবা নিতে পারবে। প্রেসক্রিপশন অডিট চালু করতে হবে। সরকারি হাসপাতালে ডায়াগনস্টিক সেবা জোরদার করতে হবে। চিকিৎসায় রেফারেল পদ্ধতি চালু করতে হবে’।