লাখ লাখ ক্ষুদ্র কৃষক, গবেষক, কৃষি উদ্ভাবন এবং সরকারি সহায়তায় বাংলাদেশ কৃষি খাতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। দেশ ধান উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে এবং ধানের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় চার গুণ। সবজি, ফল, মাছ, মাংস, দুধ ও ডিম উৎপাদনেও ব্যাপক অগ্রগতি অর্জন করেছে আমাদের দেশ। বাংলাদেশের কৃষি খাত বর্তমানে নগরায়ণ, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্যের চাহিদা বৃদ্ধির বাস্তবতা সামনে রেখে উন্নয়নের পথে অগ্রসর হচ্ছে। বর্ধিত উৎপাদন, কৃষিপণ্যের গুণমানের প্রক্রিয়াজাতকরণ, জলবায়ু সহনশীল ফসল উদ্ভাবন এবং উন্নত কৃষি অনুশীলনসহ শস্য, উদ্যানবিদ্যা, প্রাণিসম্পদ, জলজ চাষ, সুনীল অর্থনীতির (ব্লু-ইকোনমি) বিকাশ এবং কৃষির আরও অনেক ক্ষেত্রে বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে বাংলাদেশের।
স্থানীয়, আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশের জন্য আমাদের অবশ্যই ডেটা-ড্রিভেন বা তথ্যনির্ভর সমাধান এবং প্রযুক্তিগুলোকে কাজে লাগাতে হবে। স্মার্ট কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহারে আমাদের জ্ঞান সহযোগিতার প্রয়োজন রয়েছে, যা আমরা কোনোভাবেই উপেক্ষা করতে পারি না। বাংলাদেশে জলবায়ুর যে চ্যালেঞ্জ রয়েছে তা মোকাবিলা করে, কৃষির পূর্ণ সক্ষমতা পুনরুজ্জীবিত ও উন্নত করার দিকে এখন আমাদের আরও গভীর মনোনিবেশ করতে হবে। কৃষি বৈচিত্র্যের সম্ভাবনাও রয়েছে সীমাহীন, কিন্তু এখানে প্রয়োজন সৎ প্রচেষ্টা ও বিনিয়োগ। সামগ্রিক প্রবৃদ্ধির উন্নয়ন এবং দারিদ্র্য হ্রাস করতে আমাদের অবশ্যই বর্ধিত উৎপাদনশীলতা এবং কৃষির বাণিজ্যিকীকরণকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। তাই এ খাতে জলবায়ুবিষয়ক সমাধানগুলো দরকার হাতের কাছেই এবং খুব কম সময়ের ভিতর। আমরা খুব ভালোভাবেই জানি, জলবায়ু পরিবর্তন ছাড়াও উৎপাদনশীলতা কমে যাওয়া, ফসল ফলানোর পর নানা কারণে ফসলের ক্ষতি, ন্যায্যমূল্য না পাওয়া এবং অপ্রতুল খাদ্য গুদাম ব্যবস্থা- এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা অতীব জরুরি। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার একটি অনস্বীকার্য হাতিয়ার হয়ে উঠবে স্মার্ট প্রযুক্তি, যা পৃথিবীর বিভিন্ন উন্নত দেশে দেখার সুযোগ হয়েছে।
বাংলাদেশ একটি বৃহৎ ব-দ্বীপ। এ ভূমির বড় আশীর্বাদ, এটি বিশ্বের অন্যতম বিস্তৃত নদী ব্যবস্থার অন্তর্গত। জালের মতো ছড়িয়ে থাকা নদীই এ ভূমিকে উর্বর করে। সহজ সেচ ব্যবস্থাপনায় এতে ফলে সোনার ফসল। তবে নদীমাতৃক বাংলাদেশে নদী যেমন আশীর্বাদ, কিছু ঝুঁঁকিও আছে। বর্ষা মৌসুমে ৫৫-৬০% জমি পানিতে তলিয়ে যায় এবং শুষ্ক মৌসুমে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কম পানি থাকে। বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল ঘূর্ণিঝড়, টাইফুন এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ঝুঁকিতে রয়েছে। সঠিক পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা সমগ্র কৃষি ও প্রান্তিক মানুষের উন্নয়নের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। বন্যা নিয়ন্ত্রণ, পানি নিষ্কাশন, সেচ, পানি সরবরাহ এবং সমন্বিত পানি ব্যবস্থাপনা পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনার মূল বিকাশক্ষেত্র। অবশ্যই বাংলাদেশের নদীমাতৃক প্রতিবেশীদের সঙ্গে কৌশলগত সহযোগিতাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে কৃষি-কূটনীতির প্রেক্ষাপটে। আমাদের অবশ্যই কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থার টেকসই সম্প্রসারণ এবং বৈচিত্র্যকে সমর্থন করতে হবে, যা বিশ্ব ও স্থানীয় বাজারের সঙ্গে আরও ভালোভাবে সংহত, খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা প্রদানের পাশাপাশি গ্রামীণ জীবনযাত্রার উন্নতির জন্য, বিশেষ করে নারী এবং প্রান্তিক মানুষের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে।
বাংলাদেশে কৃষি খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প ধীরে ধীরে বিকশিত হচ্ছে। এসব শিল্প দেশীয় কৃষিপণ্যের ওপর অনেক বেশি নির্ভরশীল। পরিসংখ্যান বলছে এ খাতটি দেশের প্রক্রিয়াজাতকৃত উৎপাদনের ক্ষেত্রে ২২%-এর বেশি অবদান রাখে, প্রায় ২০% শ্রমশক্তি এখানে নিয়োজিত আর এ খাতটির অবদান জিডিপির প্রায় ২% (শিল্প মন্ত্রণালয়, ২০১২)। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশের কৃষিশিল্প ক্রমবর্ধমানভাবে রপ্তানি বাজারে তাদের উপস্থিতি সম্প্রসারণের দিকে বিশেষ নজর দিয়েছে। দেশে প্রায় ৭০০টি খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ উদ্যোগ রয়েছে, যার মধ্যে ছোটবড় ইউনিট আছে। এর মধ্যে অন্তত ৩০টি ম্যানুফ্যাকচারিং প্রতিষ্ঠান ফল ও সবজি প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য বিশেষায়িত। প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যের জন্য বাংলাদেশেই কিন্তু একটি বড় বাজার রয়েছে। বাংলাদেশ এগ্রো-প্রসেসরস অ্যাসোসিয়েশনের (বাপা) বর্তমান সদস্য ৪৭৯টি প্রতিষ্ঠান, যার মধ্যে রপ্তানিকারক ২৪৪টি এবং কৃষি-প্রক্রিয়াজাত পণ্য প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান রয়েছে ২৩৩টি। ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশ কৃষি-শিল্পজাত পণ্য রপ্তানিতে উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি দেখেছে। এ রপ্তানিমূল্য ২৮২.৩ বিলিয়ন টাকা, যা ২০০৬-০৭ সালে ছিল মাত্র ৭৫.৮ বিলিয়ন টাকা। এ হিসাবে রপ্তানি বেড়েছে ২৭২%। মৎস্য ও কৃষি খাতের জীবিত/হিমায়িত এবং শুকনা পণ্যের পাশাপাশি পাট ও পাটজাত পণ্যের বিভিন্ন উপকরণ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। আশার কথা উল্লেখযোগ্যভাবে, পাট এবং পাটজাত পণ্য রপ্তানি চালানে প্রাধান্য পেয়েছে।
বিশ্বে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের (ফোরআইআর) ফলে কৃষি উৎপাদন যেমন শিল্পের আকার পেয়েছে, কৃষিপণ্যের প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পের বিকাশও সম্ভাবনাময় হয়ে উঠেছে। ইন্টারনেট অব থিংস, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবোটিকস এবং অন্যান্য উন্নত প্রযুক্তির দ্রুত বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে কৃষি খাতে বিপ্লব ঘটানোর একটি যুগান্তকারী সুযোগ রয়েছে। ফোরআইআর বাস্তবায়নের মাধ্যমে প্রতিযোগিতামূলক পদ্ধতিতে কৃষিতে উৎপাদনশীলতা পরিচালনা করার জন্য একটি স্মার্ট কৃষি ব্যবস্থাপনার সুযোগ সৃষ্টি হবে। ফোরআইআরে কৃষি রোবোটিকস প্রযুক্তি ব্যবহারে শ্রমিক খরচ হ্রাস পাবে এবং নিরাপদ কৃষিপণ্যের গুণমান অটুট থাকবে, যা উন্নত বিশ্বে হরহামেশা দেখা যাচ্ছে। কৃষকরা যাতে ইন্টারনেট এবং অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলোতে প্রবেশাধিকার পান এবং তাদের মোবাইল ফোনের মাধ্যমে হালনাগাদ তথ্য সম্পর্কে অবগত থাকতে সক্ষম হন, সেটি এখন সরকারের প্রধান চ্যালেঞ্জ, যেখানে স্মার্ট কৃষি বড় একটি নিয়ামক।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রাকৃতিক সম্পদের দিক থেকে বাংলাদেশ যে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে তা মোকাবিলা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মাটি, পানি ও বনভূমির অবক্ষয় টেকসই কৃষির জন্য হুমকিস্বরূপ। উপরন্তু আবাদি জমির পরিমাণ কমছে এবং অনিশ্চিত আবহাওয়া কৃষি খাতে উন্নয়নের পথে উদ্বেগগুলোকে আরও বাড়িয়ে তুলছে। প্রান্তিক ও গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জন্য পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি, বিশেষ করে ক্রমবর্ধমান নগরায়ণ এবং মূল্যস্ফীতি মানুষের খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনছে। এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশকে অবশ্যই টেকসই কৃষি পদ্ধতিকে অগ্রাধিকার দিতে হবে, জনসংখ্যার ক্রমবর্ধমান খাদ্য চাহিদা মেটাতে গবেষণা ও উন্নয়নে বিনিয়োগ করতে হবে এবং তা সময়ের প্রয়োজনে, সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়াতে হবে। দেশের জন্য নিরাপদ ও টেকসই ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে কৃষি উৎপাদনশীলতা পরিবেশ সংরক্ষণের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা অপরিহার্য।
এ সময়ে কৃষিকে টেকসই ও আধুনিক করে তুলতে বহুমুখী পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। সর্বপ্রথম উন্নত কৌশল ও কৃষিযন্ত্রের ব্যবহার বাড়িয়ে কৃষকদের দক্ষ করে উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে বাজারমূল্য নির্ধারণ, ফসল সংরক্ষণ ও বিতরণ ব্যবস্থার আধুনিক কাঠামো গড়ে তুলতে হবে, যাতে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ করে সাধারণ মানুষের জন্য সাশ্রয়ী মূল্যে খাদ্য প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা যায়। উৎপাদক ও সরবরাহকারী হিসেবে কৃষকের স্বার্থ রক্ষা, শস্য ও চিকিৎসা বিমার প্রসার এবং কৃষকদের জন্য একটি বৈশ্বিক মানের পেনশন প্রকল্প চালুর বিষয়টিও এখন সময়োপযোগী দাবি। পাশাপাশি নিরাপত্তা বেষ্টনী ও সামাজিক সুরক্ষা জোরদার করে ক্রয়ক্ষমতার ভিতর খাদ্য প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা অপরিহার্য। উন্নত কৃষি গবেষণা, বিশেষত স্মার্ট কৃষি প্রযুক্তিভিত্তিক গবেষণায় মনোযোগ দেওয়ার পাশাপাশি বেসরকারি বিনিয়োগ ও এর প্রয়োগের জন্য কার্যকর কৌশলগত কাঠামো গড়ে তোলা প্রয়োজন। একই সঙ্গে কৃষিজমি ও কৃষি সম্পদের সুরক্ষায় আইনি হস্তক্ষেপ, কৃষিপণ্যে করছাড়, শস্যভিত্তিক বার্ষিক প্রণোদনা এবং দেশব্যাপী জাতীয় কৃষি প্রতিষ্ঠানের বিকেন্দ্রীকরণই হতে পারে বাংলাদেশের কৃষির উন্নয়নের শক্তিশালী ভিত্তি।
ষাটের দশকে সবুজ বিপ্লব এসেছিল এবং এখন আরেকটি বিপ্লবের জন্য সেরা সময় যার ব্যবস্থাপনা এবং ব্যবহার স্মার্ট এবং দক্ষ হতে হবে। ডিজিটাল দক্ষতা অর্জনে পর্যাপ্ত এবং কার্যকরী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, যেগুলো কৃষকের জন্য বাস্তবসম্মতভাবে সহজ ও কার্যকরী হবে। এগুলো সম্ভব হলে অর্থাৎ বাস্তবায়িত হলে আমরা একসঙ্গে একটি টেকসই/মজবুত পথে হাঁটতে পারব বলে বিশ্বাস রাখি। স্মার্ট বিপ্লব কৃষির দৃশ্যপটে একটি বিবর্তনমূলক পরিবর্তন আনবে, যা সবাই বুঝতে পারছি। এটি কেবল কৃষি খাতকে শক্তিশালী করবে তা নয়, বরং কার্যকরভাবে আমাদের জীবনজীবিকা পরিবর্তন করবে। এটি দারিদ্র্য এবং বৈষম্য দূর করতে সহায়তা করবে, যার বেশির ভাগই মানবসৃষ্ট। এ দারিদ্র্য ও বৈষম্য কখনোই স্মার্ট ফার্মিং প্রযুক্তির উপস্থিতিতে তৈরি হবে না।
প্রত্যেক মানুষের ভিতরেই সম্ভাবনা আছে, আর কৃষির সঙ্গে জড়িত সবাইকে এখন স্মার্ট কৃষি প্রযুক্তির এ বিশাল সম্ভাবনা বুঝতে হবে। এ প্রযুক্তিই ভবিষ্যতের বাংলাদেশে কৃষিকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে। পরিবর্তন আসে তখনই যখন দূরদৃষ্টি থাকে। কৃষি যখনই বড় কোনো চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়, তখনই দ্রুত সমাধানের প্রয়োজন পড়ে। যদিও সব সমস্যার উত্তর এখনই আমাদের কাছে নেই, তবে মনে রাখতে হবে, দেশের কৃষকরা মাটির সঙ্গে আছেন, প্রতিদিন শিখছেন, শুনছেন এবং এগিয়ে যাচ্ছেন। একইভাবে সরকার, নীতিনির্ধারক, উন্নয়ন সহযোগী এবং কৃষি খাতের অন্য অংশীদাররাও এ পরিবর্তনের অংশ। বাংলাদেশ শুধু উন্নত কৃষির স্বপ্নই দেখছে না, ধীরে ধীরে সে পথে এগিয়েও যাচ্ছে। আমাদের বিশ্বাস, কৃষক এবং কৃষি খাতকে আরও শক্তিশালী করে তুলতে পারব সবাই মিলে। এজন্য প্রত্যেককেই ইতিবাচকভাবে, একসঙ্গে, নিরলসভাবে কাজ করে যেতে হবে। কারণ হাল ছেড়ে দিলে চলবে না।
লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব