প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘নির্বাচন বানচালের জন্য দেশের ভিতর ও বাইরে থেকে অনেক শক্তি কাজ করবে। ছোটখাটো নয়, বড় শক্তি নিয়ে নির্বাচন বানচালের চেষ্টা করা হবে। হঠাৎ আক্রমণ চলে আসতে পারে, এ নির্বাচন চ্যালেঞ্জিং হবে। তবে যত ঝড়ঝাপটা আসুক না কেন, আমাদের সেটা অতিক্রম করতে হবে।’
গতকাল রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় আগামী জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা এসব কথা বলেন। বিকালে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে ব্রিফিংয়ে প্রেস সচিব শফিকুল আলম বৈঠকের বিস্তারিত তুলে ধরেন।
প্রশ্নের জবাবে প্রেস সচিব বলেন, ‘এ আক্রমণ বলতে শুধু শারীরিক নয়, বরং সাইবার অ্যাটাক বা সোশ্যাল মিডিয়ায় ভুয়া তথ্য, অপতথ্য ছড়ানোকেও বোঝানো হচ্ছে। যারা পতিত স্বৈরাচার এবং তার দোসর, তারা দেশে একটা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হোক, তা চাইবে না। এ বিষয়ে সবাইকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।’
শফিকুল আলম বলেন, ‘মূলত চারটি বিষয় নিয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। সমাজমাধ্যমে ভুয়া ও অপতথ্যের বিস্তার ঠেকানো, নির্বাচনকালীন মাঠ প্রশাসনে পদায়ন, নির্বাচনি প্রশিক্ষণ ও নিরাপত্তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। গত তিনটি নির্বাচনে যাদের ন্যূনতম সংশ্লিষ্টতা ছিল, তাদের পদায়ন করা হবে না। পদায়নের ক্ষেত্রে দক্ষতা, এসিআর, রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ড, শারীরিক দক্ষতাসহ অনেক কিছু বিবেচনায় নেওয়া হবে। নিজ জেলায় বা শ্বশুরবাড়ি এলাকাতেও পোস্টিং হবে না। কোনো কর্মকর্তার আত্মীয় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলে সেটাও পদায়নের ক্ষেত্রে বিবেচনায় রাখা হবে। সবচেয়ে ফিট কর্মকর্তাকে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় পদায়ন করা হবে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সশস্ত্র বাহিনীর ৯২ হাজার ৫০০-এর মতো সদস্য নিয়োজিত থাকবেন। এর মধ্যে ৯০ হাজার সেনাসদস্য, বাকিরা নৌবাহিনীর সদস্য। প্রতিটি জেলায় এক কোম্পানি সেনা থাকবে।’ তিনি বলেন, ‘আনসারসহ নির্বাচনি দায়িত্বে থাকা সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ১৫ নভেম্বরের মধ্যে এ কাজগুলো শেষ করতে বলা হয়েছে। প্রবাসী, কারাবন্দি ও নির্বাচনের দায়িত্বে থাকা মানুষের ভোট দেওয়ার জন্য একটি অ্যাপ তৈরি করা হচ্ছে।’
সমাজমাধ্যমে অপতথ্য ও ভুয়া তথ্যের বিষয়ে প্রেস সচিব বলেন, ‘নির্বাচনে ভুয়া ও অপতথ্য মোকাবিলায় দুটি কমিটি গঠনের বিষয়ে সভায় আলোচনা হয়েছে। দুটি কমিটিই উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত কাজ করবে এবং তাৎক্ষণিকভাবে ছড়িয়ে পড়া অপতথ্য বা ভুয়া তথ্যের ফ্যাক্ট যাচাই করে তা প্রকাশ করবে। এর জন্য কারিগরি সহায়তা দিতে আইসিটি ও সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়কে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে ফেসবুক কর্তৃপক্ষের সঙ্গেও কথা হবে।’
প্রেস সচিব বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন বিভিন্নভাবে নির্বাচন বানচালের চেষ্টা করা হবে। সোশ্যাল মিডিয়ায় অপপ্রচার আসবে। নির্বাচন বানচাল করার জন্য দেশের ভিতর থেকে, বাইরে থেকে খুবই পরিকল্পিতভাবে নানা রকম অপপ্রচার চালানো হবে। এআই ছবি-ভিডিও তৈরি করে ছেড়ে দেওয়া হবে। এটা সামাল দিতেই হবে। একটা অপপ্রচারের রচনা হওয়া মাত্র সেটা ঠেকাতে হবে, যেন ছড়াতে না পারে।’
প্রধান উপদেষ্টা আরও বলেন, ‘আগামী নির্বাচন সুন্দর ও উৎসবমুখর করতে হলে মানুষের কাছে পৌঁছাতে হবে। নির্বাচনি নীতিমালা, ভোট কেন্দ্রের নিয়ম, কীভাবে ভোট প্রদান করতে হবে, কোথাও বিশৃঙ্খলা হলে কী করতে হবে এসব বিষয়ে মানুষকে সচেতন করতে হবে। নির্বাচন কমিশন এবং সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়কে আরও বেশিসংখ্যক টিভিসি, ডকুমেন্টারি বা ভিডিও তৈরি করে দ্রুত প্রচারের ব্যবস্থা করতে হবে।’
বৈঠকে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান, প্রধান উপদেষ্টার জাতীয় সংহতি ও প্রতিরক্ষাবিষয়ক বিশেষ সহকারী লে. জে. (অব.) আবদুল হাফিজ, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব, মুখ্য সচিব সিরাজ উদ্দিন মিয়া, নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিব আখতার হোসেন, স্বরাষ্ট্র সচিব ড. নাসিমুল গনি, পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজি) বাহারুল আলম, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) মহাপরিচালক এ কে এম শহিদুর রহমান, কোস্টগার্ড মহাপরিচালক রিয়ার অ্যাডমিরাল জিয়াউল হক, বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকীসহ আরও অনেকে উপস্থিত ছিলেন।
ঐকমত্য কমিশনের প্রতিবেদন সহজবোধ্য করে প্রকাশের আহ্বান প্রধান উপদেষ্টার : জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রতিবেদনের একটি সহজবোধ্য বই প্রস্তুত করে দেশের জনগণের জন্য তা উন্মুক্ত করার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস।
গতকাল সন্ধ্যায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টার কাছে আট খে র প্রতিবেদন হস্তান্তর করেছেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্যরা। আট খে র এ প্রতিবেদনে ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশ, সভা ও কার্যবিবরণীর বিস্তারিত রয়েছে।
এ সময় প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এ প্রতিবেদন সাধারণের সহজবোধ্য একটি ভার্সন তৈরি করতে হবে। বই আকারে প্রকাশ করতে হবে যাতে সাধারণ মানুষ, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা পড়ে বুঝতে পারে এবং অন্যদেরও বোঝাতে পারে। বইটি ইংরেজি ও বাংলা দুই ভাষাতেই প্রকাশ করতে হবে।
প্রধান উপদেষ্টা আরও বলেন, ভবিষ্যতে এ বইটি যেন শিক্ষার্থীদের জন্য অবশ্যপাঠ্য হয়ে যায়, সেটিও বিবেচনায় রাখতে হবে। তরুণ প্রজন্ম বইটি পড়বে, তারা নিজেরা জানবে এবং তাদের বাবা-মাকেও জানাবে এতে কী আছে। প্রতিবেদন হস্তান্তরকালে উপস্থিত ছিলেন ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি প্রফেসর আলী রীয়াজ, কমিশন সদস্য বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, ড. ইফতেখারুজ্জামান, ড. বদিউল আলম মজুমদার, ড. মো. আইয়ুব মিয়া এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার।
প্রফেসর আলী রীয়াজ বলেন, আট খণ্ডের এ প্রতিবেদনে জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫, এ কমিশনের কার্যক্রমের প্রক্রিয়া, প্রেক্ষাপট, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে প্রাপ্ত লিখিত প্রস্তাবনা, সাধারণ মানুষের মতামত, রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে কমিশনের পক্ষ থেকে প্রেরিত স্প্রেডশিট, সব ধরনের আলোচনা ও সংলাপ লিপিবদ্ধ আছে। আমাদের বিশ্বাস- ভবিষ্যতে এ আট খে র প্রতিবেদন বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেশে-বিদেশে গবেষণার জন্য দলিল হয়ে উঠবে।