চট্টগ্রাম-কক্সবাজার দেশের প্রথম জাতীয় মহাসড়ক। চট্টগ্রামেই দেশের বৃহত্তম সমুদ্রবন্দর। আছে জাতীয় রাজস্ব আয়ের আধার কাস্টমস। চট্টগ্রাম দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম নগর। বাণিজ্যিক রাজধানী। কক্সবাজারে পৃথিবীর বৃহত্তম সমুদ্র সৈকত। এখানে প্রতিনিয়তই দেশিবিদেশি পর্যটকদের সমাগম। কক্সবাজারেই উৎপাদন হয় সাদা সোনা খ্যাত দেশের মোট চাহিদার ৯০ শতাংশ লবণ। কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে চলছে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণসহ বিভিন্ন উন্নয়নযজ্ঞ। নানা দিক দিয়েই কক্সবাজার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জেলা। অথচ এর সঙ্গে চট্টগ্রাম ও ঢাকার সড়ক পথে যোগাযোগের প্রধান সড়কটিই দুই লেনের। স্বাধীনতার প্রায় সাড়ে পাঁচ দশক পার হলেও এমন গুরুত্বপূর্ণ সড়কটি এখনো চার বা ছয় লেনে উন্নীত করা হয়নি। চট্টগ্রাম-কক্সবাজারে দেশবাসী অনেক উন্নয়নযজ্ঞ দেখলেও যোগাযোগের প্রধান সড়কটিই চরমভাবে অবহেলিত। অথচ এ দুই লেনের সরু সড়ক দিয়েই দিনে প্রায় ৩০ হাজার যানবাহন চলাচল করে। প্রতিনিয়ত এ সংখ্যা বাড়ে। সরু সড়ক দিয়ে যান চলতে গিয়ে প্রতিদিনই ঘটছে দুর্ঘটনা। হারাচ্ছে প্রাণ। কর্মক্ষম মানুষকে হারিয়ে নিঃস্ব হচ্ছে কত পরিবার।
দুই. একটি টনক নড়ার মতো সড়ক দুর্ঘটনা ঘটবে, কিছুদিন হইচই হবে, মানববন্ধন, বিক্ষোভ সমাবেশ, প্রতিবাদসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালিত হবে। সরকারকে দেওয়া হবে স্মারকলিপি। ঘটনার পর প্রথমে দুই-তিন দিন গণমাধ্যমের প্রথম পৃষ্ঠায়, এরপর শেষ পৃষ্ঠায়, এরপর ভিতরের পাতায় চলে যায় ঘটনাটি। এরই মধ্যে আরেকটি নতুন ঘটনার অবতারণা হয়। আগের দুর্ঘটনাটি মুহূর্তেই ধামাচাপা পড়ে যায়। এভাবেই শেষ হয়ে যায় একটি মর্মান্তিক, মর্মন্তুদ এবং লোমহর্ষক সড়ক দুর্ঘটনার ইতিবৃত্ত। কদিন পর আবারও অভিন্ন ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে। কিন্তু আগের ঘটনার কোনো কূলকিনারা হয় না। কারও কোনো বিচার হয় না। অভিযুক্তদের কারও শাস্তি হয় না। চালক কিংবা ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে। আইন থাকলেও তা শব্দের ছাপা অক্ষরে বন্দি। আইন আইনের জায়গায় ঠিকই আছে। কিন্তু বাস্তবায়নের কোনো উদ্যোগ থাকে না। সরকারি সংস্থাগুলো দুর্ঘটনার পর কদিন দৌড়ঝাঁপ করে। এরপর আবারও যথানিয়মে হিমাগারে চলে যায় সবকিছু। গত ২ এপ্রিল চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের লোহাগাড়া উপজেলার চুনতি জাঙ্গালিয়া এলাকায় একটি বাসের সঙ্গে মাইক্রোবাসের সংঘর্ষে এক পরিবারের ৪ জনসহ ১১ জনের মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় নাড়া দেয় চট্টগ্রাম-কক্সবাজারের বাসিন্দাদের। তবে কর্তৃপক্ষের কুম্ভকর্ণের ঘুম ভাঙছে কিনা তা নিয়ে সংশয় আছে। হাইওয়ে পুলিশের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের ১৫৫ কিলোমিটারের মধ্যে ১০০ কিলোমিটার ঝুঁকিপূর্ণ। এর মধ্যে সাতকানিয়ার কেরানীহাট থেকে কক্সবাজার সদরের খরলিয়া পর্যন্ত ৮৩ কিলোমিটার অধিক ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত। এ অংশে গত এক বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায় ১৩০ জন। দেশের জাতীয় মহাসড়কগুলোয় দুর্ঘটনার প্রায় ৫০ শতাংশই ঘটে এ সড়কে। সড়ক দুর্ঘটনার ৫৩ শতাংশ ঘটে অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানো এবং ৩৭ শতাংশ ঘটে চালকদের বেপরোয়া মনোভাবের কারণে। ৯০ শতাংশ দুর্ঘটনাই ঘটে চালকের বেপরোয়া মনোভাব ও গতির কারণে। ১০ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনার জন্য প্রতিযোগিতার মনোভাব ও পথযাত্রীর অসাবধানতা দায়ী।
তিন. আর কত প্রাণ চাই? কত মায়ের বুক খালি হতে হবে? কত অবুঝ মায়াময় কোমলমতি শিশু অকালে বাবা-মা হারা হবে? একটি দেশের প্রথম সারির মহাসড়কে এতগুলো লাশ পৃথিবীর কোনো সভ্য দেশে এটি হয়তো কল্পনাও করা যায় না।
অথচ এ দেশে এটি এখন বাস্তব ও নির্মম সত্য। সরকারের প্রতি আকুল আবেদন- প্লিজ, এবার উদ্যোগ নিন। আর নয় দুর্ঘটনার নামক এ হত্যাকাণ্ড। সড়কটি ছয় লেনে উন্নীত করা হোক। পিচঢালা কালো পথ আর যেন লাল রক্তে রঞ্জিত না হয়। কালো রাজপথে সাদা কাপড়ে মোড়ানো দেহ জাতি আর দেখতে চায় না। এটি জনদাবি, গণদাবি। রাজনৈতিক বা ব্যাক্তি স্বার্থের দাবি নয়।
লেখক : গণমাধ্যমকর্মী