ইসলামের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দুনিয়ার রাষ্ট্রগুলোকে প্রধানত তিন ভাগে ভাগ করা হয়। যেমন—দারুল ইসলাম (ইসলামী রাষ্ট্র), দারুল আমন (নিরাপদ রাষ্ট্র) ও দারুল খাওফ (ভীতিকর রাষ্ট্র)।
রাষ্ট্র একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান। সমাজ, সম্প্রদায়, জনসমষ্টি, ভূখণ্ড, সরকার, সার্বভৌমত্ব ইত্যাদি বিষয় নিয়ে রাষ্ট্র গঠিত হয়।
এ জন্য সমকালীন রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সুসম্পর্ক বিধান করা গুরুত্বপূর্ণ। মহানবী (সা.) মদিনা রাষ্ট্রের সঙ্গে তৎকালীন পৃথিবীর অন্যান্য রাষ্ট্রের সঙ্গে যেরূপ সম্পর্ক রেখেছিলেন এবং পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তের মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের যে নির্দেশনা দিয়েছেন—তা অত্যন্ত দূরদর্শী, মানবিক ও সর্বজনীন। তাঁর আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক কিছু কর্মপন্থা নিচে উল্লেখ করা হলো—
১. ভ্রাতৃত্ব ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক : পৃথিবীর রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের প্রথম ভিত্তি এটি। পৃথিবীর সব মানুষ ভাই ভাই।
আদম (আ.) সবার পিতা। মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে বলেন, ‘হে মানবসমাজ! তোমরা তোমাদের রবকে ভয় করো। যিনি তোমাদের এক ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং যিনি তার থেকে তার সঙ্গিণীকে সৃষ্টি করেছেন। আর তাদের দুজন থেকে সৃষ্টি করেছেন অগণিত পুরুষ ও নারী।
’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ১)
রাসুলুল্লাহ (সা.) ভ্রাতৃত্বের প্রকরণকে অঞ্চল কিংবা ভূখণ্ড বিবেচনায় সীমিত করেননি, বরং ব্যাপক করে রেখেছেন। ফলে তা সব মানব ভ্রাতৃত্বকে অন্তর্ভুক্ত করে।
২. পারস্পরিক স্বীকৃতি দান : রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় পারস্পরিক স্বীকৃতি প্রদান অতি গুরুত্বপূর্ণ। রাষ্ট্র ক্ষুদ্র হোক অথবা বৃহৎ, মুসলিম হোক অথবা অমুসলিম বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় স্বীকৃতি প্রদান জরুরি। ইসলামের ইতিহাসের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলে দেখা যায়, রাসুলুল্লাহ (সা.) স্বীয় সাহাবিদের আবিসিনিয়ায় হিজরতের নির্দেশ দানের মাধ্যমে আবিসিনিয়া রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিয়েছেন।
অনুরূপভাবে তিনি বিশ্বের বড় বড় রাষ্ট্রের অধিপতিদের কাছে ওই রাষ্ট্রগুলোর স্বীকৃতি দানের মাধ্যমে উদারতা ও বৈষম্যহীনতার পরিচয় দিয়েছেন।
(ইবনু হিশাম, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৩৪৩)
৩. ধর্মীয় স্বাধীনতা : ইসলাম ভিন্ন মত, আকিদা ও বিশ্বাসের স্বাধীনতাকে সর্বদা সম্মানের চোখে দেখে। ধর্মের ব্যাপারে জোরজবরদস্তি ইসলাম সমর্থন করে না। মহান আল্লাহ বলেন, ‘দ্বিনের ব্যাপারে কোনো জবরদস্তি বা বাধ্যবাধকতা নেই।’ (সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ২৫৬)
একবার উমর (রা.) ইলিয়া অধিবাসীদের বসতিতে গেলেন, সেখানে ইহুদিদের ধুলায় ধূসরিত একটি মন্দির দেখতে পান। অতঃপর তিনি কাপড় এনে ধুলাবালি পরিষ্কার করা শুরু করলেন। তারপর মুসলমানদের একটি দলও শরিক হলো। ফলে মন্দিরটি ধুলাবালিমুক্ত হলো। ব্যবহার যোগ্যতা ফিরে পেল। এতে ইহুদিদের একটি ধর্মীয় সম্মানিত স্থান মর্যাদা ফিরে পেল। (ইবনু আসাকির, তারিখু মাদিনাতু দিমাশক আল কাবির, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা-১৭৯)
৪. কূটনৈতিক সম্পর্ক : ইসলামে কূটনৈতিক সম্পর্কের নীতিতে আছে সুমহান আদর্শ। কূটনৈতিক ব্যক্তি, রাষ্ট্রদূত বা প্রতিনিধি সবাই ইসলামী রাষ্ট্রের সবচেয়ে সম্মানিত ও শ্রদ্ধার পাত্র। তারা মুসলিম হোক কিংবা অমুসলিম বৈষম্যহীনভাবে সবাই সমান মর্যাদা পাবে। তাদের অধিকার ও মর্যাদা রক্ষায় রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর আদর্শ চিরকাল সমাদৃত ও অনুসরণীয় থাকবে। শত্রু পক্ষ থেকেও কোনো দূত এলে রাসুলুল্লাহ (সা.) তাদের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করার এবং তাদের পূর্ণ নিরাপত্তা দেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন। যেমন—রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে নবুয়তের মিথ্যা দাবিদার মুসায়লামাতুল কাজ্জাব একটি পত্র লিখে দুজন দূত প্রেরণ করে। সেখানে লেখা ছিল—‘আমি নবুয়তের ব্যাপারে আপনার অংশীদার। তাই অর্ধেক দেশ আমার।’
(আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যাহ, পৃষ্ঠা-২৮৭-২৮৮)
কিন্তু মহানবী (সা.) দূতদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন।
৫. চিঠিপত্র আদান-প্রদান : মহানবী (সা.)-এর আন্তর্জাতিক সম্পর্ক স্থাপনে তাঁর প্রেরিত চিঠিপত্রের একটি বড় ভূমিকা ছিল। প্রেরিত চিঠির সংখ্যা সম্পর্কে সঠিক কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। তবে মিসরীয় ইতিহাস গবেষক ড. হামিদুল্লাহর মতে, প্রিয় নবী (সা.) যাঁদের কাছে চিঠি পাঠিয়েছিলেন তাঁদের সংখ্যা ২০০ থেকে ২৫০। (কালের কণ্ঠ, ১ ডিসেম্বর ২০১৭)
নবীজি (সা.)-এর চিঠির প্রাপকদের ভেতর ১০ জন শাসক ও পাঁচজন আঞ্চলিক প্রশাসক বা গোত্রপতি ছিলেন। তাঁদের উদ্দেশে লেখা চিঠিগুলোর বিস্তারিত বিবরণ ইতিহাসের গ্রন্থে পাওয়া যায়।
বিডি প্রতিদিন/কেএ