ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা, যা মানুষের কথাবার্তা, আচরণ, বিতর্ক, জ্ঞানচর্চা ও সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে যথার্থ আচার-ব্যবহার শিখিয়ে দেয়। বিশেষ করে ধর্মীয় আলোচনা, কোরআন-হাদিস ব্যাখ্যা, এবং নবী-রসুল ও সাহাবাগণের মান-মর্যাদা রক্ষার ক্ষেত্রে ইসলাম অতিমাত্রায় সংবেদনশীল। কারণ এ মহান ব্যক্তিত্বরা দীন প্রতিষ্ঠার পথপ্রদর্শক এবং তাদের সম্পর্কে বিরূপাচরণ বা অসম্মান মুসলিম সমাজে বিভেদ ও হানাহানির জন্ম দেয়।
ধর্মীয় আলোচনা : আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘তোমার প্রতিপালকের পথে মানুষকে আহ্বান করো প্রজ্ঞার সঙ্গে, নেক উপদেশের মাধ্যমে, আর তাদের সঙ্গে বিতর্ক করো উত্তম রীতিতে।’ (সুরা আন নাহল-১২৫)
এ আয়াতে ইসলামি বিতর্কশীলতার মর্মভিত্তি স্পষ্ট : রসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকাল বিশ্বাস করে, সে ভালো কথা বলবে অথবা নীরব থাকবে।’ (বুখারি, মুসলিম)
ধর্মীয় আলোচনায় অপ্রয়োজনীয় কঠোরতা, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ, রাগান্বিত ভাষা, এবং ব্যক্তিগত আক্রমণ-সবই ইসলামে নিষিদ্ধ। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘অশ্লীল ও কঠোর ভাষা আল্লাহ পছন্দ করেন না।’ (সুরা আন নিসা-১৪৮)। এ থেকে বোঝা যায়, দাওয়াহ বা বিতর্ক যদি উত্তেজনা, শত্রুতা ও বিভেদ সৃষ্টি করে তবে তা ইসলামের প্রকৃত রীতি নয়। নবী-রসুলগণের সম্মান রক্ষা মুসলিমদের কর্তব্য। নবী মুহাম্মদ (সা.) হলেন মুসলিম উম্মাহর প্রাণ। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয়ই আমরা তোমাকে প্রেরণ করেছি সাক্ষী, সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী হিসেবে; যেন তোমরা তাঁকে সম্মান করো, সাহায্য করো ও আল্লাহর পবিত্রতা ঘোষণা করো।’ (সুরা আল ফাতাহ-৮-৯)
নবী (সা.)-এর সম্মান রক্ষা মানে, তাঁর সুন্নাহকে সম্মান করা। তাঁর জীবনকে আলোচনায় সহনশীলতা ও শালীনতার সঙ্গে উপস্থাপন করা। তাঁর ব্যক্তিত্ব নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ থেকে বিরত থাকা। সামাজিক মাধ্যমে তাঁর সম্পর্কে বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়ানো থেকে বিরত থাকা। রসুল (সা.) বলেছেন, ‘আমার সম্পর্কে কথা বলো; তবে সত্য ছাড়া কিছু বলো না।’ (তিরমিজি)। সুতরাং তাঁর কথা, কর্ম, বাণী, বা হাদিস উদ্ধৃতিতে যাচাইবাছাই করা প্রতিটি মুসলমানের দায়িত্ব।
সাহাবাগণের মর্যাদা : কোরআনে সাহাবাগণের প্রশংসা করে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহ তাঁদের ওপর সন্তুষ্ট এবং তাঁরা আল্লাহর ওপর সন্তুষ্ট।’ (সুরা আত তওবা-১০০)
রসুল (সা.) বলেছেন, ‘আমার সাহাবিদের গালি দিও না। যার হাতে আমার প্রাণ, কেউ যদি ওহুদের স্বর্ণ পরিমাণ দান করে, সাহাবিদের একটি মুঠো দানের সমান হবে না।’ (বুখারি, মুসলিম)। সাহাবিদের নিয়ে অপবাদ, বদনাম, তর্ক-বিতর্ক সৃষ্টি করা মুসলিম ঐক্যের জন্য ক্ষতিকর। ধর্মীয় আলোচনায় সাহাবিদের জীবন, সাহস, ত্যাগ ও অবদানকে সম্মান সহকারে তুলে ধরা প্রকৃত ইমানদারের বৈশিষ্ট্য।
মতভেদে : আদব ও সহনশীলতার ইসলাম মতভেদকে স্বীকার করে, কিন্তু সেটিকে নৈতিকতার ভিতরে সীমাবদ্ধ করেছে। চার ইমাম- ইমাম আবু হানিফা, ইমাম মালিক, শাফেঈ ও আহমাদ-পরস্পরের মতের সঙ্গে ভিন্ন হলেও কখনো অসম্মান করেননি। বরং তারা বলেছেন, ‘আমার মত সঠিক, তবে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা আছে; অন্যের মত ভুল, তবে সঠিক হওয়ার সম্ভাবনা আছে।’ ধর্মীয় আলোচনার মূলনীতি : ব্যক্তিকে নয়, যুক্তিকে প্রতিহত করা। দোয়া ও বিনয়ের সঙ্গে বিতর্ক। ভিন্নমতকে অপমান না করা। দলাদলি ও গোষ্ঠীগত বিভেদ সৃষ্টি না করা। সামাজিক মাধ্যমে ইসলাম আলোচনা করার শিষ্টাচার বর্তমান যুগে ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটকসহ বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্মে ধর্মীয় আলোচনা জনপ্রিয় হয়েছে। কিন্তু সেখানে কিছু নীতিমালা মানা অপরিহার্য-যাচাই করে তথ্য প্রচার, কোরআন-হাদিসের উদ্ধৃতি সঠিক উৎসসহ দেওয়া, ব্যক্তিগত বিদ্বেষপূর্ণ মন্তব্য থেকে বিরত থাকা, ভুল পেলে নম্রভাবে সংশোধন করা, নবী ও সাহাবিদের সম্পর্কে বিতর্কমূলক কনটেন্টে অংশ না নেওয়া। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা এমন বিষয়ের পেছনে যেও না, যার সম্পর্কে তোমাদের কোনো জ্ঞান নেই।’ (সুরা আল ইসরা-৩৬)। ধর্মীয় আলোচনায় উত্তম শিষ্টাচার সমাজে- ঐক্য সৃষ্টি করে, সত্য জ্ঞান প্রতিষ্ঠা করে, হৃদয়কে নরম করে, আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করায়। রসুল (সা.) বলেছেন, ‘মুমিনের পরিপূর্ণ ইমান তার উত্তম চরিত্রেই।’ (তিরমিজি)। সুশৃঙ্খল সমাজ : এটি একটি আদর্শ ও সুশৃঙ্খল সমাজ গঠনে সাহায্য করে।
পারস্পরিক ঐক্য : শিষ্টাচার পারস্পরিক ঐক্য ও সংহতি বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
আত্মিক উন্নয়ন : এটি মানুষকে উন্নত চরিত্র এবং ভালো আচরণের অধিকারী করে তোলে। ইসলাম ধর্মীয় আলোচনাকে বিনয়, হিকমত ও উত্তম চরিত্রে সুশোভিত করতে নির্দেশ দেয়। নবী-রসুল ও সাহাবাগণের মর্যাদা রক্ষা করা প্রতিটি মুসলমানের ইমানের দাবি। আজকের বিভেদপূর্ণ সময়ে কোরআন-হাদিসের নির্দেশিত শিষ্টাচার অনুসরণ করলে দীন, সমাজ ও উম্মাহ-সবই উপকৃত হবে। আল্লাহ আমাদের সত্যের প্রতি অবিচলতা, আদবের সঙ্গে জ্ঞানচর্চা এবং ইসলামের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্বদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা প্রদর্শনের তৌফিক দান করুন, আমিন।
লেখক : গবেষক, ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার, বসুন্ধরা, ঢাকা