বাংলাদেশের রাজনীতিবিদরা নিজেদের এত বিজ্ঞ মনে করেন যে, তাদের চেয়ে জ্ঞানী, পড়াশোনা জানা লোকজনের অস্তিত্ব দেশে থাকতে পারে তারা এমন ভাবতেই পারেন না। বাক্যবাগীশতায় তারা এত পটু যে, আলাপের মজলিশে মুহূর্তেই তারা জটিল থেকে জটিলতর সমস্যার নিষ্পত্তির সূত্র তুলে ধরেন; যুগের পর যুগ ধরে জট পাকিয়ে থাকা বৈশ্বিক সমস্যার মোক্ষম সমাধান দেন আলোচনার টেবিলে। রাজনীতিবিদদের এই মহাবিজ্ঞতার কারণে তারা বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রতিটি পর্যায়ে দেশ ও জনগণকে বিপদে ফেলেছেন। তারা স্বাধীনতার ভিন্ন ভিন্ন সংজ্ঞা ও ব্যাখ্যা দেন। তাদের একাংশের ব্যাখ্যায় সাতচল্লিশে দেশ স্বাধীন হয়নি। আরেক অংশের ব্যাখ্যায় একাত্তরে নয়, প্রকৃত স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে ২০২৪-এর ৫ আগস্ট। এই মহাপণ্ডিত রাজনীতিবিদদের কখনো বড় কোনো বিপদ হয়নি।
তারা বিপদের আভাস পেয়ে নিরাপদে সটকে পড়েছেন, স্বেচ্ছায় ধরা দিয়েছেন, বড়জোর দুর্নীতিজনিত মামলা-মোকদ্দমায় ফেঁসে কিছুকাল কারাগারে আয়েশি দিন যাপন করেছেন। কিন্তু রাজনীতিবিদদের তত্ত্বের ঘোরে পড়ে ও তাদের ক্ষমতায় যাওয়ার লালসার শিকার হয়েছে দেশের সাধারণ মানুষ। তারা লাখে লাখে, হাজারে হাজারে জীবন দিয়েছে, ধর্ষিত ও লুণ্ঠিত হয়েছে, বাস্তুচ্যুত হয়েছে। জনগণের এই ত্যাগের সুফল ভোগ করেছেন সুখ ও সুসময়ের সন্তান রাজনীতিবিদরা।
রাজনীতিবিদরা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেন না, তারা জনগণকে নসিহত করেন ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে। তাদের বাগাড়ম্বরের মাত্রা এত বেশি যে, দেশে ১০০টি রাজনৈতিক দল থাকলেও ছোটবড় প্রতিটি রাজনৈতিক দলের নেতারা দাবি করতে দ্বিধা করেন না যে দেশের সমগ্র জনগোষ্ঠী তাদের সঙ্গে আছে এবং একমাত্র তারাই বাংলাদেশের জনগণকে প্রতিনিধিত্ব করতে পারেন। কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করার মতো জনবল না থাকা এবং নির্বাচনে শূন্য দশমিক ১ শতাংশ ভোট না পাওয়া দলের নেতারা টেলিভিশন টকশোতে জাতীয় সমস্যার যেসব সমাধান দেন, তা তারা নিজেদের জীবনে বাস্তবায়ন করলে জাতি বিশেষভাবে উপকৃত হতো বলে আমার বিশ্বাস। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে আমার সামান্য পড়াশোনা এবং বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতি পর্যবেক্ষণে ততধিক কম অভিজ্ঞতায় আমি যা বুঝি, তা হলো, যে জনগণের নাম ভাঙিয়ে দেশের রাজধানী এবং কয়েকটি বড় শহরে বসবাসকারী গুটিকয় ব্যক্তি, যারা নিজেদের বিরাট ত্যাগী ‘রাজনীতিবিদ’ ও দেশ-জাতির আনোয়ার হোসেইন মঞ্জুদণ্ডমুণ্ডের কর্তা বিবেচনা করলেও নানা সময়ে তারাই জনগণের ওপর ধ্বংসের প্রলয় চাপিয়ে দেওয়া ছাড়া আর কিছু করতে সক্ষম হননি। একাত্তরের পর সর্বমোট ২৫ বছর দেশ শাসনকারী শেখ মুজিবুর রহমান এবং শেখ হাসিনা এর ব্যতিক্রম কিছু করতে পারেননি। বরং বাংলাদেশের ইতিহাসে পিতা ও কন্যার শাসনামলের মতো দুঃশাসন জনগণ আর দেখেনি।
রাজনীতিবিদদের কারণে বাংলাদেশের রাজনীতি ক্রমবর্ধমানভাবে জমিদারি আমলের চর দখলের মতো ঘটনার রূপ ধারণ করেছে। রাজনীতিবিদদের মুখ্য দায়িত্ব যেখানে জনগণের প্রতিনিধিত্ব করা, জনস্বার্থ রক্ষামূলক সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করা, এর পরিবর্তে তারা যে কোনো উপায়ে এবং তাদেরই পরিভাষায় ‘লাশের ওপর দিয়ে’ হলেও ক্ষমতার আসন দখল করাকেই তাদের প্রধান রাজনৈতিক আদর্শ ও উদ্দেশ্য বলে বিবেচনা করেন। খুব পেছনে না গিয়ে জনগণ শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার উদ্দেশ্যে পরিচালিত ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের ভোটার ও বিরোধী দলের অংশগ্রহণবিহীন তিনটি নির্বাচন পর্যালোচনা করলেই আঁচ করতে পারে যে তারা আসলে কী চেয়েছিলেন। অন্য বড় রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মকাণ্ড ও আওয়ামী লীগের চেয়ে খুব একটা আলাদা নয়।
প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর এ ধরনের কর্মকাণ্ডে জনগণ রাজনীতির প্রতি আগ্রহ হারিয়েছে। জনগণের কাছে রাজনীতি ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ ও হাস্য-পরিহাসের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। রাজনৈতিক নেতা, প্রতিষ্ঠান অথবা ক্ষমতাসীন দলের স্বার্থে গৃহীত রাষ্ট্রীয় নীতি বিদ্রুপ ও পরিহাসমূলক সাহিত্য এবং নাটকের চরিত্র ও বিষয়বস্তু। রাজনীতিকে ভালো দৃষ্টিতে দেখে এমন মানুষের সংখ্যা সমাজে খুব কম। তবু রাজনীতিবিদরা বোঝেন না যে, তারা জনগণকে মিথ্যা আশ্বাস ও প্রলোভন দিয়ে তাদের কাছে কৌতুকের পাত্র-পাত্রীতে পরিণত হয়েছেন। তারা যদি ছলেবলে কৌশলে ক্ষমতায়ও যান, তাহলেও জনগণের কাছে তারা ‘তাসের রাজা’র চেয়ে বেশি কিছু থাকেন না। যার উৎকৃষ্ট প্রমাণ স্বয়ং শেখ মুজিবুর রহমান, যিনি সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে রোমান সম্রাট মারকাস আলপিয়াস ট্রাজানাস (৫৩-১১৭ খ্রিস্টাব্দ)-এর মতো অপ্রতিদ্বন্দ্বী ক্ষমতা উপভোগ করেছেন এবং তার উপযুক্ত কন্যা শেখ হাসিনা, যিনি ফারাও যুগের শেষ মিসরীয় রানি ষষ্ঠ ক্লিওপেট্টার (৫১-৩০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) মতো ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য ভারতের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলেন, ঠিক ক্লিওপেট্টা যেভাবে রোমানদের কৃপার ওপর নির্ভর করতেন। শেখ মুজিব ও শেখ হাসিনার আজীবন ক্ষমতায় টিকে থাকার সাধ চুরমার হয়ে গেছে। এসব দৃষ্টান্ত থেকেও যদি রাজনীতিবিদরা কিছু শিখতেন, তাহলে দেশের জন্য কল্যাণকর হতো। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতিবিদরা সম্ভবত কোনো কিছু না শেখা ও না বোঝার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কারণ তারা মনে করেন, কোনো কিছু বুঝতে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে, নিজেদের অন্যের কাছে নিজেকে কম বিজ্ঞ প্রমাণ করা ও উপহাসের পাত্রে পরিণত করা।
বাংলাদেশে এ মুহূর্তের রাজনৈতিক পরিস্থিতি দেখে রাজনীতি সচেতন যে কারও মনে দুর্ভাবনার উদয় হবে যে, মাত্র এক বছর দুই মাস আগে বাংলাদেশে প্রায় ২ হাজার নিহতের শোকগাথা বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যাওয়া এবং রাজপথে ফ্যাসিবাদী সরকারের লেলিয়ে দেওয়া বাহিনীর গুলিতে পঙ্গুত্ববরণকারী অসংখ্য আন্দোলনকারীসহ ২০ সহস্রাধিক আহতের রক্তের দাগ ও ক্ষতস্থান শুকানোর আগেই আওয়ামী লীগশূন্য বাংলাদেশের রাজনৈতিক গগনে রাজনীতিবিদদের নিজ নিজ মর্জি অথবা দলীয় প্রধানের অভিপ্সা চরিতার্থ করতে ক্ষমতায় যাওয়ার নেশা দেশকে আরেকটি বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দেওয়ার সব লক্ষণ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। রাজনৈতিক দলগুলোর যখন আওয়ামী লীগের মতো একটি ঠাঙ্গাড়ে, সন্ত্রাসী দলকে যেখানে পাকিস্তান সৃষ্টির কৃতিত্বের দাবিদার মুসলিম লীগের মতো বিলুপ্তির পথে ঠেলে দেওয়ার সম্মিলিত ঐক্য প্রয়োজন, তখন প্রতিটি রাজনৈতিক ইস্যুতে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে দ্বন্দ্ব, সংস্কার নিয়ে মতানৈক্য, এমনকি সংবিধানে সংযোজনের জন্য ‘জুলাই সনদ’ স্বাক্ষর করা নিয়েও যে তামাশা দেখা গেছে, তা কোনোভাবেই সুস্থ ও স্বাভাবিক রাজনৈতিক আচরণ ছিল না। প্রতিটি রাজনৈতিক নেতা-কর্মী সম্ভবত ভুলে গেছে যে, সাড়ে ১৫ বছরের আওয়ামী শাসনে তারা কীভাবে তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছিলেন। ‘জুলাই আন্দোলন’ তাদের জন্য আল্লাহ প্রদত্ত বিশেষ অনুগ্রহ ছিল মর্মে শুকরিয়া আদায়ের পরিবর্তে তারা কলহ-কোন্দল ও একে অন্যের প্রতি বিষোদ্গার শুরু করেছেন। এ পরিস্থিতির সুযোগ গ্রহণ করছে আওয়ামী লীগের প্রতি কোমল ও আওয়ামী শাসনামলে নানাভাবে সুবিধা ভোগকারীরা। তারা সুযোগ পেলেই বলতে চেষ্টা করেন, ‘আওয়ামী লীগের শাসনই ভালো ছিল!’
আওয়ামী শাসন কোনো সময়েই ভালো ছিল না। শেখ মুজিবের সাড়ে তিন বছরেও আওয়ামী শাসন ভালো ছিল না, শেখ হাসিনার পাঁচ মেয়াদে সাড়ে ২১ বছরেও না। শুধু বাংলাদেশ নয়, তৃতীয় বিশ্বেও যে কোনো দেশে আওয়ামী লীগের মতো বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন কোনো রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় গেলে সে দেশে অনিবার্যভাবে কবরের নিস্তব্ধতা নেমে আসে, বর্বরোচিত নিপীড়নের শিকার হয়ে জনগণ প্রতিবাদের ভাষা হারিয়ে ফেলে, কোনোভাবেই সরকারের বিরুদ্ধে কার্যকর আন্দোলন গড়ে চেতনা উজ্জীবিত হতে পারে না। আওয়ামী দুঃশাসনে বাংলাদেশেও তাই ঘটেছিল। বিক্ষুব্ধ তরুণরা যদি মরণপণ সংগ্রাম নিয়ে মাঠে না নামত, অকাতরে জীবন না দিত, তাহলে আর কতকাল নিপীড়িতের কণ্ঠ নিস্তব্ধ থাকত, তা অনুমান করলে এখনো ভীতি জাগে। বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই জনগণ আওয়ামী দুঃশাসনের অভিজ্ঞতা লাভ করতে শুরু করেছিল; রাজনীতিবিদদের অভিজ্ঞতা হয়েছে আরও বেশি। এসব অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও তাদের কেউ কাউকে ছাড় দিতে নারাজ। বিএনপি যা বলছে, জামায়াতে ইসলামী তার বিপরীত কথা বলছে। জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) কথার সঙ্গে কারও বনিবনা হচ্ছে না।
বিএনপি জাতীয় নির্বাচনের আগে ‘গণভোট’ চায় না। জামায়াতে ইসলামী জাতীয় নির্বাচনের আগে ‘গণভোট’ চায়। বর্তমানে এ দুটিই তো বড় দল। এ দুটি দলের মধ্যে গলায় গলায় ভাব ছিল, তা তো বেশি দিন আগের কথা নয়। হঠাৎ তাদের মিলনে চিড় ধরল কেন? কারণ একটাই- ক্ষমতা। বিএনপি মনে করছে, নির্বাচন হলেই তারা বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় সরকার গঠন করবে এবং জামায়াতের সমর্থনের প্রয়োজন নেই। অতএব বিএনপির কাছে জামায়াত এখন কুলুখের ন্যাকড়া। অন্যদিকে জামায়াত সম্পর্কে জনগণের একটি অংশের ধারণা জন্মেছে যে, শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করার আন্দোলনের পরিকল্পনাকারী ও সহযোগিতা দানকারী ছিল জামায়াত এবং জামায়াতই অন্তর্বর্তী সরকারের পেছনে থেকে সব কলকাঠি নাড়ছে। জনগণের এই ভাবনা জামায়াতকে নিশ্চয়ই চাঙা করে থাকবে, যে কারণে জামায়াত নেতাদের মনেও এ ধারণা সৃষ্টি হয়েছে যে, তারা বাংলাদেশে সরকার পরিচালনা করার সক্ষমতা অর্জন করেছে। যদিও সরকার পরিচালনায় জামায়াতের সামর্থ্য নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে, সে সম্পর্কে এখানে আলোচনা করে নিবন্ধের কলেবর দীর্ঘ করতে চাই না। পরবর্তীতে আমার সন্দেহের পূর্বাপর রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক দিকগুলো পাঠকের কাছে উপস্থাপনের আশা রাখি।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে সাধারণ মানুষের কী ঘটছে, তারা কী ভাবছে এবং গত বছরের রাজনৈতিক পট পরিবর্তন থেকে তা কী আকাক্সক্ষা পোষণ করছে, রাজনীতিবিদরা যে তা আদৌ আমলে নিচ্ছেন না, তা দেশকে নতুন বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিতে পারে। তারা যদি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে আন্তরিক না হন এবং জনগণ তাদের মনে কী পোষণ করছে তা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হন, তাহলে ধরে নিতে হবে যে, তাদের ভাবনায় জনগণের কোনো স্থান নেই। তারা কেবল নিজেদের ক্ষমতা ও মর্যাদার আসনে দেখতে চান। কিন্তু তারা এটাও বুঝে উঠতে অক্ষম যে, তাদের অধিকাংশই সমাজের খুব সংকীর্ণ একটি অবস্থান থেকে উঠে আসেন এবং তারা যাদের প্রতিনিধিত্ব করতে চান, নির্বাচনে বিজয়ী হলে তাদের নির্বাচকদের চেয়ে উচ্চ মর্যাদার অধিকারী হন। এখানেই যত বিপত্তি ঘটে। তারা ধরাকে সরা জ্ঞান করতে শুরু করেন এবং ক্ষমতায় যাওয়ার সহজ পথ অনুসন্ধান করা ছাড়া তাদের আর কোনো চিন্তা থাকে না।
আওয়ামী লীগ সহজ পথে তাদের ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী রূপ দিতে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়েছে। তাদের দৃষ্টান্তই বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলোকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। ক্ষমতায় যাওয়ার সহজ পথ অনুসন্ধানের পরিবর্তে বিবাদ এড়িয়ে রাজনৈতিক সহাবস্থানের পথ বেছে নিলেই তারা দেশ ও জাতির কল্যাণ সাধন করতে পারবেন।
লেখক : যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী সিনিয়র সাংবাদিক