প্রযুক্তির কল্যাণে এ দেশে অনলাইন মিডিয়া বেশ এগিয়েছে। ঠিক উল্টো পথ ধরে প্রিন্ট মিডিয়া পিছিয়ে পড়েছে অনেকটাই। প্রশ্ন হলো, প্রযুক্তির এই যুগে তাহলে কি প্রিন্ট মিডিয়া হারিয়ে যাবে? ৪৯ বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রে ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে ১৯৭৪ সালে নিউজ রিপোর্ট নামে প্রথম অনলাইন নিউজ পোর্টাল প্রকাশিত হয়। এরপর বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন সংবাদপত্র তাদের অনলাইন সংস্করণ চালু শুরু করে।
তবে ২০০০ সালে যুক্তরাজ্য থেকে প্রকাশিত সাউথপোর্ট রিপোর্টার আধুনিক অনলাইন নিউজ পোর্টাল হিসেবে পরিচিতি পায়। ২০০৪ সালে যাত্রা শুরু করে দেশের প্রথম অনলাইন নিউজ পোর্টাল বিডিনিউজ ২৪.কম। বিশিষ্ট সাংবাদিক আলমগীর হোসেন ছিলেন এর প্রধান সম্পাদক ও অন্যতম উদ্যোক্তা। তবে আর্থিক সংকটের কারণে ২০০৬ সালের সেপ্টেম্বরে বিডিনিউজের মালিকানা কিনে নেন বিবিসির সাবেক সাংবাদিক তৌফিক ইমরোজ খালেদী।
এর কিছু সময় পরেই যাত্রা শুরু করে আরেক অনলাইন নিউজ পোর্টাল দ্য এডিটর ডট নেট। এরই ধারাবাহিকতায় দেশে বেশ কিছু অনলাইন নিউজ পোর্টাল জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। পাশাপাশি দেশের শীর্ষ দৈনিকগুলোর অনলাইনও জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠে আসে।
২০০৮ সালের কথা।
আমার এক প্রিয় সাংবাদিক এক আড্ডায় বলছিলেন, তাঁরা অনলাইন মিডিয়া করছেন। নাম ফোকাস বাংলা। আমাকেও উদ্বুদ্ধ করলেন। আমিও সে সময় নিউজ বাংলাদেশ.কম নামে একটি অনলাইন পোর্টাল চালু করলাম। রাজধানীর দিলকুশার বিসিআইসি ভবনের ১৭ তলায় কার্যক্রম শুরু করি।
বিপদে পড়লাম। কারণ অনলাইনে কাজ করার লোকও ছিল না তখন। আর অনেকের এ নিয়ে আগ্রহও ছিল কম। তখন এটি মানুষের কাছে সহজ কিংবা পরিচিত বিষয় নয়। কিন্তু কিছুদিন গেলেই দেখলাম অনলাইন মিডিয়া দ্রুতই এগোচ্ছে। এই পরিবর্তনের সঙ্গে অনেক দৈনিক তাদের পত্রিকার অনলাইন ভার্সন চালু করে। সেটিই ছিল গোনা কয়েকটি। এখন তো অখ্যাত আর আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকারও অনলাইন ভার্সন আছে হাজার হাজার। ‘সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট’ এই সূত্রে আমাদের প্রিন্ট পত্রিকার পরিবর্তন শুরু হয়। এখন তো মানুষ প্রিন্ট পত্রিকা যতটা না পড়ে, তার চেয়ে বহুগুণ ওই পত্রিকার অনলাইন সংস্করণে যুক্ত থাকে। আমাদের দেশের প্রিন্ট পত্রিকাগুলো সময়ের সঙ্গে নিজেদের বদলে নিয়েছে। প্রিন্ট মিডিয়া তাদের অনলাইন সংস্করণ শুরু করলেও তারা কিন্তু আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারেনি। বেশির ভাগ পত্রিকার অনলাইন ভার্সন পাঠককে ফ্রিতেই দিতে হচ্ছে।
তবে যেভাবেই হোক, গত দুই দশকে বাংলাদেশে অনলাইন পত্রিকার বিকাশ ঘটেছে বিস্তৃত আকারে। এ দেশে অনলাইন পোর্টাল তৈরিও সহজলভ্য। তবে সংখ্যায় নিয়ন্ত্রণহীন হারে বাড়লেও মানসম্মত ও বিশ্বাসযোগ্য অনলাইন পত্রিকা সে অর্থে এখনো বিরল। যেগুলো মানসম্পন্ন বলা চলে, তার প্রায় সবই প্রথম সারির মুদ্রিত পত্রিকা বা টেলিভিশন চ্যানেলের অনলাইন ভার্সন। তবে নতুন প্রযুক্তিনির্ভর অনলাইন প্ল্যাটফর্মই যে আগামী দিনের গণমাধ্যমের সূতিকাগার হতে যাচ্ছে, গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞরা অন্তত সে বিষয়ে নিঃসন্দেহ।
বেশির ভাগ মানুষের ধারণা, খুব কম আয়োজনের মধ্য দিয়েই একটি অনলাইন পত্রিকার মালিক বা প্রকাশক বা সম্পাদক হওয়া যায়। ফলে অনেকেই কেবল এই সুযোগটি উপভোগ করতেই এক বা একাধিক অনলাইন পত্রিকা চালু করে থাকেন। পরে সেটিকে চালু রাখার তাগিদে অন্যান্য মাধ্যম থেকে সংবাদ ও অন্যান্য আধেয় ‘চুরি’ করা ছাড়া তাঁদের আর গত্যন্তর থাকে না। নিজেদের পরিচিতি বাড়াতে অনেকে মিথ্যা ও ‘মুখরোচক’ সংবাদ তৈরি করে প্রচার করেন। কষ্টের কথা হলো, এসব মুখরোচক সংবাদের কারণে অখ্যাত অনলাইনগুলোর সংবাদও ভাইরাল হয়ে যায়। এতে অনলাইন মালিকের হয় পোয়াবারো। আবার একজনের মনগড়া সংবাদ অনলাইন পত্রিকার জনপ্রিয় বা ‘সর্বাধিক পঠিত’ খবর হয়ে উঠছে।
অনেক অনলাইন নকল আর চুরি করা খবরের পাশাপাশি ভুয়া খবর দিয়ে ভরা থাকে। এতে বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নের মুখে পড়ছে। যেহেতু অনলাইন প্ল্যাটফর্ম সামনের দিনগুলোতে গণমাধ্যমের মূল আশ্রয়স্থল হতে যাচ্ছে, তাই যাঁরা অনলাইনের মালিক কিংবা সম্পাদক, সংবাদ প্রকাশের ব্যাপারে তাঁদের অনেক বেশি দায়িত্বশীল হতে হবে। অনলাইন গণমাধ্যমের কারণে ‘হলুদ সাংবাদিক’ অনেক বেড়ে গেছে। সেদিন জাতীয় প্রেস ক্লাবে সিনিয়র কয়েকজন সাংবাদিকের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিলাম। এ প্রসঙ্গে একজন আক্ষেপ করে বলেন, ‘চারদিকে সবই তো দেখি সাংবাদিক।’ দু-তিন হাজার টাকা দিয়ে কোনো রকমে একটি অনলাইন পোর্টাল খুলেই সাংবাদিক পরিচয় দেন। বলেন, ‘আমি অমুক অনলাইন পত্রিকার সম্পাদক।’ এতে প্রকৃত এবং ভুয়া অনলাইন পোর্টালের মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ করা খুব কঠিন হয়ে গেছে।
মিথ্যার ভিড়ে মানুষ এখন আর অনলাইনের সংবাদ বিশ্বাস করতে চায় না। কোনটি সঠিক আর কোনটি ভুয়া সংবাদ, তা নিয়ে বিভ্রান্ত পাঠক। সামনের দিনগুলোতে টিকে থাকতে হলে গণমাধ্যমগুলোকে এই আস্থাহীনতা কাটিয়ে উঠতে হবে। প্রতিদিন চটকদার খবর কিংবা অসার চমৎকারিত্ব নয়, বরং বিশ্বাসযোগ্যতাই একটি গণমাধ্যমের সাফল্যের মূলশক্তি। মনে রাখতে হবে, মিথ্যার ওপর ভর করে যতটুকু এগোনো যায়, তার চেয়ে পিছিয়ে যেতে হয় অনেক। ভুল বা মিথ্যা তথ্যের ‘সরস’ উপস্থাপন দিয়ে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করা যায় না। নয়া এই প্রযুক্তি আমাদের কল্যাণেই সৃষ্টি। তা শতভাগ কাজে লাগাতে হবে। অনলাইন মাধ্যমে সঠিক সংবাদ প্রচার করা না গেলে অনলাইন গণমাধ্যমগুলোকে অচিরেই অস্তিত্ব সংকটে পড়তে হবে।
ইন্টারনেট প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে এই অনলাইন গণমাধ্যম তথ্যকে নিমেষেই ছড়িয়ে দিচ্ছে সারা বিশ্বে। অনলাইন মাধ্যম মানেই অবাধ ও দ্রুতগামী তথ্যপ্রবাহ। কয়েক বছর আগেও অনলাইন মিডিয়ার সাংবাদিকদের তেমন গুরুত্ব দিতে চাইত না অনেকে। কিন্তু এখন সময় বদলে গেছে। বাংলাদেশে অনলাইন মিডিয়ার সাংবাদিকতা অনেক এগিয়ে গেছে। অনলাইন মিডিয়ার সাংবাদিকরা এখন সামনের সারিতে চলে আসছেন। কিন্তু অনলাইন সাংবাদিকতা আর প্রিন্ট মিডিয়ার সাংবাদিকতা আলাদা কিছু নয়। একটি প্রিন্টে যাচ্ছে আর অন্যটি অনলাইনে। আর উভয় ক্ষেত্রে সাংবাদিকতার মূলনীতি মেনে চলতে হয়। যেখানে এর ব্যত্যয় ঘটে, সেখানেই বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নের মুখে পড়ে—তা সে অনলাইন হোক কিংবা প্রিন্ট। তবে বাস্তব কারণে অনলাইনের
খবরটিই এখন মানুষের কাছে বেশি পৌঁছায় আর এ জন্য সেটির গুরুত্বও বাড়ছে। অন্যদিকে প্রিন্ট মিডিয়া ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় একটি সংবাদের জন্য সীমাবদ্ধ স্পেস থাকে। অনলাইন মিডিয়ায় তা থাকে না। সেখানে ইচ্ছামতো লেখা ও ছবি সংযোজন করা যায়।
মানুষকে খবর জানানো ও খবর বিশ্লেষণে দীর্ঘদিন ধরে একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তার করে এসেছে মুদ্রিত সংবাদপত্র। টেলিভিশনের আবির্ভাব এই একাধিপত্য খানিকটা খর্ব করলেও পুরোপুরি পারেনি। একসময় অনেকে ধারণা করেছিলেন, চলমান ছবিসহ খবর পরিবেশনা মুদ্রিত সংবাদপত্রের বিলুপ্তি ঘটাবে। কিন্তু এই ধারণা সঠিক বলে প্রমাণিত হয়নি। বর্তমানে
ইন্টারনেটের ব্যাপক প্রসার, কম্পিউটার ও মোবাইল ফোনের সহজলভ্যতা প্রযুক্তিভিত্তিক নতুন এই সংবাদমাধ্যমকে দ্রুত জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছে। নিউজ পোর্টালের কল্যাণে মানুষ এখন বাসা, অফিস তো বটেই, চলতি পথেও জেনে নিতে পারছে দেশ-বিদেশের সর্বশেষ সংবাদ। পোর্টালগুলোতে থাকছে খবরের বিশ্লেষণও। সুযোগ রয়েছে যেকোনো খবরের ব্যাপারে মন্তব্য করারও। ফলে সত্যিকারভাবেই মুদ্রিত সংবাদপত্রগুলোর জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে নিউজ পোর্টাল। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় হাত গুটিয়ে বসে নেই সনাতনি সংবাদপত্রগুলোও। অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে তারাও প্রিন্টের পাশাপাশি খুলছে অনলাইন ভার্সন। ঘুরেফিরে তাদের হাতেই থাকছে অনলাইন মিডিয়াও। এই অর্থে প্রিন্ট পত্রিকার মালিকরা যখন দেখবেন প্রিন্ট পত্রিকা প্রকাশে খরচ বেশি, লোকবলও অনেক প্রয়োজন হয়, সে ক্ষেত্রে তাঁরা হয়তো কোনো এক সময় প্রিন্ট পত্রিকা বন্ধ করার কথা ভাববেন।
যুক্তরাষ্ট্রে গত কয়েক বছরে পুরনো ও নামজাদা একাধিক পত্রিকা হয় বন্ধ হয়ে গেছে, নয়তো দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় আদালতের আশ্রয় প্রার্থনা করেছে। কোনো ক্রেতা না মিললে দৈনিক পত্রিকা বন্ধ হয়ে যাবে, এটিই স্বাভাবিক। উন্নত দেশের অনেক প্রিন্ট পত্রিকা ফ্রিতে দিতে দেখা যায়। আমি গত বছরও যুক্তরাজ্যে গিয়ে এয়ারপোর্ট, মেট্রোর স্টেশন, সুপার মলের সামনে ফ্রিতে পত্রিকা বিলি করতে দেখেছি। প্রিন্ট পত্রিকা হারিয়ে না গেলেও এর যে ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল, তা বলা যাবে না।
লেখক : গবেষক, কলামিস্ট