বাংলা চলচ্চিত্রের নব্বই দশক মানেই একটি নামের প্রতিচ্ছবি, সালমান শাহ। মাত্র তিন বছরের ক্ষণস্থায়ী ক্যারিয়ারে তিনি যে জনপ্রিয়তার শিখর ছুঁয়েছিলেন, তা বাংলা সিনেমার ইতিহাসে এক বিরল ঘটনা। তিনি এসেছিলেন এক ধূমকেতুর মতো, দর্শকদের মন জয় করে খুব দ্রুতই চলে গিয়েছিলেন। আজও তিনি তার ভক্তদের হৃদয়ে অম্লান, এক নস্টালজিক হাহাকার। চলচ্চিত্রে আসার আগে ইমন নামে তিনি প্রথম আলোচিত হন ১৯৮৫-৮৬ সালের দিকে হানিফ সংকেতের গ্রন্থনায় প্রচারিত ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘কথার কথা’র একটি মিউজিক ভিডিওতে। ‘নামটি ছিল তার অপূর্ব’ নামের সেই গানের মিউজিক ভিডিওতে মাদকাসক্ত তরুণের চরিত্রে তার অভিনয় দর্শক মহলে সাড়া ফেলেছিল। এরপর তিনি আবদুল্লাহ আল মামুনের প্রযোজনায় ‘পাথর সময়’ নাটকে এবং কয়েকটি বিজ্ঞাপনচিত্র করেন।
কেয়ামত থেকে কেয়ামত দিয়ে বিস্ফোরণ
বাংলা চলচ্চিত্রে সালমানের আবির্ভাব ছিল এক বিস্ফোরণ। ১৯৯৩ সালের ঈদুল ফিতরে মুক্তি পায় সোহানুর রহমান সোহান পরিচালিত রেকর্ড-ব্রেকিং ব্যবসাসফল ছবি ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’। এটি ছিল হিন্দি ছবি ‘কেয়ামত সে কেয়ামত তক’-এর বাংলা সংস্করণ। নবাগত সালমান খানিকটা আমির খানের স্টাইলে দর্শকদের সামনে এলেন, তার সুদর্শন চেহারা ও অভিনয়ে মুগ্ধ হলো দর্শক। তার বিপরীতে প্রথম নায়িকা হিসেবে ছিলেন মৌসুমী। ছবিতে দুই অভিজাত পরিবারের দ্বন্দ্বের কারণে দুই তরুণ-তরুণীর করুণ পরিণতি দর্শকের চোখে জল এনেছিল। প্রথম ছবিতেই সালমান পেয়েছিলেন আকাশছোঁয়া সাফল্য। ছবিটি তোজাম্মেল হক বকুলের ‘বেদের মেয়ে জোসনা’র পর অন্যতম ব্যবসাসফল ছবি হিসেবে গণ্য হয়। ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’-এর পরপরই সালমান- মৌসুমী জুটি উপহার দেয় তাদের দ্বিতীয় সুপারহিট ছবি ‘অন্তরে অন্তরে’ (১৯৯৪)। এটি ছিল শিবলী সাদিকের পারিবারিক ও রোমান্টিক প্রেমের ছবি, যেখানে প্রথম ছবির বিয়োগান্তক সমাপ্তির পর দর্শক তাদের মিলন দেখতে পেয়ে সন্তুষ্ট হয়েছিল। তবে এরপরই অজানা কারণে এই সুপারহিট জুটি একসঙ্গে কাজ না করার সিদ্ধান্ত নিলে পরিচালক-প্রযোজকরা বিপাকে পড়েন।
শাবনূরের সঙ্গে নতুন অধ্যায়ের সূচনা
সালমান যখন মৌসুমীবিহীন একা, ঠিক তখনই প্রয়াত পরিচালক জহিরুল হক নবাগত শাবনূরকে নিয়ে জুটি বাঁধেন। ১৯৯৪ সালে মুক্তি পায় সালমান-শাবনূর জুটির প্রথম ছবি ‘তুমি আমার’। ছবিটি মুক্তির পরপরই সুপারহিট হয়, যা শাবনূরকে তার প্রথম সফলতার স্বাদ এনে দেয়। এ ছবির সাফল্যের মধ্য দিয়েই বাংলা চলচ্চিত্র পায় তার সবচেয়ে জনপ্রিয় ও সফল জুটি, সালমান-শাবনূর। এই জুটির টানা সাফল্যের ধারাবাহিকতায় আসে ‘বিক্ষোভ’ (১৯৯৪)। মোহাম্মদ হান্নান পরিচালিত এ ছবিতে রোমান্টিক সালমানের বদলে দর্শকরা দেখলেন প্রতিবাদী এক অ্যাকশনধর্মী নায়ককে। বাংলাদেশের অন্ধকার ছাত্ররাজনীতির নির্মম চিত্র ফুটিয়ে তোলা ছবিটিও ব্যাপক সাড়া ফেলে। তবে সালমান রোমান্টিক ঘরানার ছবিতেই বেশি কাজ করেছেন। মৌসুমীর সঙ্গে তার জুটি বাঁধা শেষ হয়ে যায়নি। ১৯৯৫ সালের রোজার ঈদে শফি বিক্রমপুরী পরিচালিত ‘দেনমোহর’ ছবিতে তৃতীয়বারের মতো এই জুটিকে দেখা যায়। এটিও বক্স অফিসে সুপারহিট হয়। এ ছবিতে জমিদারপুত্রের চরিত্রে সালমানের অভিনয়, বিশেষ করে তার জেদ, রাগ এবং নিরহংকার ব্যক্তিত্বের মিশ্রণ দর্শকমহলে প্রশংসিত হয়। এটি সালমান-মৌসুমী জুটির টানা তৃতীয় সুপারহিট ছবি।
স্বল্প পরিসরের দীর্ঘ ছায়া
মাত্র তিন বছরের ক্যারিয়ারে সালমান শাহ মোট ২৭টি ছবিতে অভিনয় করেন, যার মধ্যে শাবনূরের সঙ্গেই সর্বাধিক ১৪টি ছবিতে জুটি বাঁধেন।
সালমান শাহ বহু গুণী পরিচালকের সঙ্গে কাজ করলেও কামাল আহমেদ, এ জে মিন্টু, কাজী হায়াত, শহিদুল ইসলাম খোকন, মোস্তফা আনোয়ার, চাষী নজরুল ইসলাম, আমজাদ হোসেনের মতো খ্যাতিমান পরিচালকদের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পাননি। এই আক্ষেপ হয়তো চিরকাল তার ভক্তদের মাঝে রয়ে যাবে। ১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর শুক্রবার এই ক্ষণজন্মা তারকা মাত্র ২৫ বছর বয়সে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে যান। তার শেষ মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি ছিল ‘বুকের ভেতর আগুন’ (১৯৯৭)।