আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে কোন দল সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে সরকার গঠন করবে, তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত হবে কি না, অথবা আদৌ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে কি না। দায়িত্ব গ্রহণের পর অন্তর্বর্তী সরকারের ১৪ মাস অতিক্রান্ত হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে তাদের পক্ষে কি নির্বাচন সম্পন্ন করে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা আদৌ সম্ভব হতো না?
বাংলাদেশের পেছনের নির্বাচনি ইতিহাস থেকেই উপলব্ধি করা যেতে পারে, তাগিদ থাকলে অসম্ভবকে সম্ভব করে তোলা কোনো ব্যাপারই নয়। অন্তর্বর্তী সরকারের শুরুটাই ছিল ঢিমেতেতালা গতিতে। তারা ধরেই নিয়েছে, রাজনৈতিক ময়দানে তেমন গুরুত্বপূর্ণ কোনো প্রতিপক্ষ নেই দেশের প্রধান দুটি দল বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী ক্ষমতাচ্যুত এবং কার্যক্রম নিষিদ্ধ ও নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগবঞ্চিত আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে বাধাহীনভাবে তাদের রাজনৈতিক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। আওয়ামী লীগের কার্যক্রম যদি অব্যাহত থাকত, তাহলে আওয়ামী লীগের দ্বারা বিএনপি ও জামায়াতের এত নির্বিবাদে হম্বিতম্বি করার উপায় থাকত না। আওয়ামী লীগ জন্মলগ্ন থেকে কোনো রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ সহ্য করার সংস্কৃতি লালন করে বেড়ে ওঠেনি। দেশে এমন কোনো রাজনৈতিক দল নেই, যার নেতা-কর্মীরা আওয়ামী লীগের ঠেঙানি খায়নি বা আওয়ামী লীগের লালিত মাস্তানদের হাতে খুনজখম হয়নি।
আওয়ামী লীগ সরকারে থাকলে দানব, সরকারে না থাকলে ঘোষিত সন্ত্রাসী দল। উভয় অবস্থাতেই তাদের সব কর্মকাণ্ডকে তারা ‘গণতান্ত্রিক’ ও ‘বৃহত্তর জনগণ’ কর্তৃক সমর্থিত বলে দাবি করে। তারা গণতন্ত্রের পীর, পূজারি সবকিছু। তাদের মধ্য থেকেই জন্ম নেয় ‘গণতন্ত্রের মানসপুত্র’ ও ‘গণতন্ত্রের মানসকন্যা’। তাদের মাঝেই থাকে ‘বঙ্গবন্ধু’, ‘দেশরত্ন’, ‘বঙ্গমাতা’ ইত্যাদি। এসব শিরোপা গ্রহণে আওয়ামী লীগকে কেউ কখনো ডিঙিয়ে যেতে পারেনি। কত দেশের সরকারই তো নানা কারণে ক্ষমতা থেকে অপসারিত হয়। গণবিক্ষোভে হয়, সামরিক বাহিনীর হাতে হয় এবং পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারালেও ক্ষমতা থেকে অপসারিত হতে হয়। নতুন সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে ক্ষমতাচ্যুত সরকারের অনেককে গ্রেপ্তার করে। তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও ক্ষমতায় থাকাকালে কৃত বাড়াবাড়ির জন্য মামলা দায়ের করা হয়। অনেক সময় কেউ দোষী সাব্যস্ত হয়ে শাস্তি লাভ করে। অনেকে নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে খালাস পায়। তাদের বেশির ভাগ দেশেই থাকে। বিশ্বজুড়েই এমন ঘটে। এতে লজ্জার কিছু নেই।
কিন্তু আওয়ামী লীগ এমন নির্লজ্জ একটি দল নির্বাচিত হওয়ার ছয় মাসের মধ্যে ব্যাপক গণবিদ্রোহে ক্ষমতাচ্যুত হওয়া ও দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পরও সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং অন্যান্য মন্ত্রী ও নেতা লজ্জাশরমের মাথা খেয়ে বলছেন, ‘শেখ হাসিনাই এখনো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী’ এবং ‘সংবিধান অনুযায়ী আওয়ামী লীগ সরকারই এখনো বৈধ।’ গণবিদ্রোহকে তারা জনমতের প্রতিফলন বলে বিবেচনা করে না। কখনো করেনি। তাদের কাছে ভোটার ও প্রতিদ্বন্দ্বীবিহীন, রাতের বেলায় ব্যালট বাক্সে নৌকার পক্ষে ব্যালটে সিল মেরে বাক্স ভরার নাম জনমতের প্রতিফলন। সেজন্য শেখ হাসিনা দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর থেকে ‘টুপ করে দেশে ঢুকে পড়া’র মতো কথা বলে আওয়ামী লীগের ভাঙা দুর্গে দামামা বাজানোর চেষ্টা করে পরিস্থিতিকে দেশ ও জনগণের জন্য এবং বিশেষ করে নিজেদের জন্য জটিল করার চেষ্টা করেন। এটাই আওয়ামী লীগের রাজনীতি।
অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে যদি সেনাবাহিনীর অকুণ্ঠ সমর্থন না থাকত; আওয়ামী লীগের কার্যক্রমের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা না হতো এবং বিশেষ করে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করা না হতো, তাহলে ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে ২০২৫ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ১৪ মাসে আওয়ামী লীগের লালিত গুন্ডা-মাস্তানদের হাতে প্রতিপক্ষের কতজন নেতা-কর্মী হতাহত হতে পারত, তা ২০০৮ সালের নির্বাচনপূর্ব আট-দশ বছর আওয়ামী লীগের হাতে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী হত্যা ও জখমের ঘটনা হিসাব করলেই যে কেউ পেয়ে যাবেন।
সেই আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামী যে নিরাপদে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে, সেটাই তাদের জন্য আশীর্বাদ। কিন্তু এ আশীর্বাদকে তারা হজম করতে পারছে না। সরকার ও নির্বাচনব্যবস্থার ওপর নানা তত্ত্ব দিয়ে এবং বিভিন্ন বিভাগ ও ব্যবস্থার সংস্কারের প্রশ্নে তারা একদিকে নিজেদের মাঝে ব্যবধান সৃষ্টি করেছে, অন্যদিকে সংস্কার ও নির্বাচন অনুষ্ঠান অহেতুক বিলম্বিত করে জনমনে প্রশ্ন সৃষ্টির সুযোগ দিয়েছে। জুলাই-আগস্ট গণ অভ্যুত্থানে জাতির ওপর চেপে বসা ফ্যাসিবাদের শিখণ্ডী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগকে সরকার ও রাজনীতি থেকে নির্বাসনে পাঠানোর জন্য টানা সাড়ে ১৫ বছর আধুনিক বিশ্বের বর্বরতম নিপীড়নের শিকার রাজনৈতিক দল ও জনগণের মধ্যে যে ঐক্য গড়ে উঠেছিল, ১৪ মাস পর তা আর সেই পর্যায়ে নেই। রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যুত্থান-পরবর্তী ঐক্য দৃশ্যত ক্ষণস্থায়ী ছিল। আন্দোলনের সাফল্য অর্জিত হওয়ার ছয় মাসের মধ্যে দেখা গেছে জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের সাফল্য অর্জনের কৃতিত্বের মূল দাবিদার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতি জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থনকে বিএনপি ও জামায়াত সুদৃষ্টিতে দেখেনি। আন্দোলনের সমন্বয়করা নিজেদের রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) গঠন করার পর বিএনপি এবং জামায়াত উভয় দল নাখোশ হয়। তারা এনসিপি এবং নবগঠিত দলটির কোনো কোনো নেতাকে নিয়ে নানা কটু মন্তব্য করতে থাকে, যা এখনো অব্যাহত রয়েছে। উভয় দল চেয়েছিল, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা-কর্মীরা তাদের পক্ষপুটে থেকে কাজ করবেন এবং এর বিনিময়ে তারা জাতীয় সংসদে ছাত্রদের গুটি কয়েক আসনে প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দিয়ে তাদের বাহবা কুড়াবে।
দেশে অভাবিতপূর্ণ একটি বিপ্লব ঘটানোর মূল নেতৃত্ব প্রদানকারী ছাত্র সমন্বয়করা রাজনীতিবিদদের চোখে কয়েক মাসের ব্যবধানে শিশু, অবুঝ ইত্যাদি হয়ে গেল। ন্যূনতম কৃতজ্ঞতাবোধ থাকলে হালুয়ারুটিতে ভাগ বসানো রাজনৈতিক দল ও তাদের নেতাদের পক্ষে এহেন আচরণ করা সম্ভব হতো না। এনসিপি নেতাদের ব্যাপারে কী বলেছেন বিএনপি ও জামায়াতের নেতারা? বিএনপি মনে হয় তাদের নেতা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ফজলুর রহমানকে লেলিয়ে দিয়েছিল এনসিপি নেতাদের চরিত্রহনন করার জন্য। তিনি আবোলতাবোল বলে যাচ্ছিলেন এবং বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব চুপচাপ উপভোগ করছিল। যা হোক শেষ পর্যন্ত ফজলুর রহমানের দলীয় পদ তিন মাসের জন্য স্থগিত করেছে বিএনপি। টক শোতে জনপ্রিয় বিএনপি নেত্রী রুমিন ফারহানাও এনসিপি নেতাদের নিয়ে আপত্তিকর বক্তব্য দিয়ে ক্ষোভের সৃষ্টি করেছেন। ছোটখাটো নেতারাও নানা কটূক্তি করতে ছাড়েননি।
সভ্য-ভদ্র লোকদের দল হিসেবে খ্যাত জামায়াতে ইসলামীর নেতারাও এনসিপিকে নিয়ে কটূক্তি করতে পিছু হটেনি। যাদের ত্যাগে জামায়াত আজকের এই অবস্থানে, যারা তাদের সুযোগ করে দিয়েছে যখনতখন ক্ষমতার উৎসগুলোতে গিয়ে কথা বলার, তাদের তারা তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে কথা বলতে শুরু করেছে। জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার সম্প্রতি জামায়াতের আচরিত সৌজন্যের বাইরে চলে গিয়ে তাদের দলের এক সমাবেশে এনসিপি নেতাদের উদ্দেশে বলেছেন, ‘তোমরা নতুন ছাত্রদের দল। জন্ম নিয়েই বাপের সঙ্গে পাল্লা দিও না। জামায়াতের সঙ্গে পাল্লা দিতে হলে অনেক দূর যেতে হবে।’ জামায়াতের সঙ্গে পাল্লা দিতে কত দূর যেতে হবে? চব্বিশের আগস্টপূর্ব সাড়ে ১৫টি বছর জামায়াত কোথায় ছিল? ২০১০ থেকে আওয়ামী লীগের ধাওয়ায় এবং আওয়ামী লীগ সরকারের বিচারিক প্রহসনের ধারায় যখন জামায়াতের শীর্ষ নেতৃত্ব ফাঁসিতে ঝুলে পৃথিবী ত্যাগ করছিলেন, তখন তো তারা আওয়ামী লীগের কেশাগ্র স্পর্শ করতে পারেনি। এখন যে তারা বড় বড় কথা বলছে, রাজনৈতিক এবং বিশেষ করে জামায়াতের ক্ষেত্রে ‘ইসলামি শিষ্টাচার’-এর খেলাপ করে কারও ‘বাপ’ হওয়ার দাবি করছে, তা কাদের অবদান, সম্ভবত তা-ও বিস্মৃত হয়েছেন জামায়াতের কিছু কিছু নেতা। হতে পারে, জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীরা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মাঝে ঘাপটি মেরে বা জামায়াতের পরিভাষায় ‘হিকমত’-এর আশ্রয় নিয়ে আওয়ামী সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক গণ আন্দোলনের প্রস্তুতি গ্রহণে ভূমিকা রেখেছে। আন্দোলনকে নানাভাবে শক্তি ও সমর্থন জুগিয়েছে, কিন্তু আন্দোলনের নেতারা এনসিপির নেতৃত্বে এসে প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলোর অস্তিত্বের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠলে তাদের প্রতি বিরূপ ধারণা পোষণ করতে হবে কেন অথবা তাদের ঘায়েল করার মতো কথাবার্তা বলতে হবে কেন। এনসিপির নেতৃত্বে যাদের দেখা যাচ্ছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে তো তারাই ছিলেন। আন্দোলনের সফলতায় কদিন আগেও যারা বীর হিসেবে সমাদৃত হয়েছেন, রাজনৈতিক মঞ্চে অবতীর্ণ হওয়ার কারণে তাদের এখন ‘ভিলেন’ ভাবতে হবে কেন? বিএনপি যে কোনো উপায়ে ক্ষমতায় যেতে ব্যগ্র, এনসিপির অবদানকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে চাইলে তারা আওয়ামী সংস্কৃতির ধারক হিসেবে তা করতে পারে। কিন্তু এনসিপিকে সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য উৎসাহিত করার পরিবর্তে তাদের প্রতি ‘অসৌজন্যমূলক’ ও হেয়প্রতিপন্ন করার মতো আচরণ জামায়াতের ‘রাজনৈতিক ঔদ্ধত্যের’ বহিঃপ্রকাশ ছাড়া কিছু নয়। এনসিপি নেতারা যদি জামায়াত বা বিএনপিকে নিয়ে কোনো কথা বলেও থাকেন, তাহলে বিগত মাসগুলোতে এনসিপির প্রতি এই দুই দলের বক্তব্য থেকে সুস্পষ্ট বোঝা যায়, তারা এনসিপিকে বাধ্য করেছেন তাদের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে। একজন এনসিপি নেতা জামায়াত নেতার বক্তব্যের কঠোর সমালোচনা করে বলেছেন, গণ অভ্যুত্থানই এ সময়ের সব রাজনৈতিক দলের উৎস। জামায়াত আন্দোলনে অংশ নিয়েছে বলে আন্দোলনের নেতৃত্ব দাবি করা তাদের বালখিল্যতা। তিনি যথার্থই বলেছেন, আওয়ামী শাসনামলে কোথায় ছিল বিএনপি ও জামায়াত? এ প্রশ্ন তোলা তো অযৌক্তিক নয়।
বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রতিটি মোড়ে নতুন দলই সব সময় প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছে। ১৯৫৪ সালে কয়েকটি নতুন দলের সমন্বয়ে গঠিত নির্বাচনি জোট ‘যুক্তফ্রন্ট’ পূর্ব পাকিস্তানে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগকে গো-হারা হারিয়েছিল। ১৯৭৯ সালে নবগঠিত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) প্রতিষ্ঠিত দলগুলোর ওপর আধিপত্য বিস্তার করেছিল। একনায়ক এরশাদের গঠিত জাতীয় পার্টির নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও একই দৃষ্টান্ত প্রযোজ্য। এনসিপি নতুন দল। আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তাদের জন্ম। তারা রাজনীতিতে নতুন সংস্কৃতি সৃষ্টি করার চেষ্টা করলে প্রতিষ্ঠিত পুরোনো দলগুলোর উচিত তাদের উৎসাহিত করা। এর বিপরীত কিছু করলে তারা আবারও তাদের রাজনৈতিক বালখিল্যতার পরিচয় দেবে এবং দেশ আবারও মুখ থুবড়ে পড়বে। তাদের মাঝে শুভবুদ্ধির উদয় হোক।
লেখক : নিউইয়র্কপ্রবাসী, সিনিয়র সাংবাদিক