অবকাঠামো উন্নয়ন না করেই দেশে ৩০ শতাংশ ইলেকট্রিক যান (ইভি) কেনার শর্ত দিয়ে একটি নীতিমালা করতে যাচ্ছে সরকার। ওই শর্ত মেনে ২০৩০ সাল পর্যন্ত অর্থাৎ আগামী পাঁচ বছর সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান এবং বিভিন্ন করপোরেশনকে যানবাহন কিনতে হবে। ইলেকট্রিক ভেহিকেল নীতিমালায় এই শর্তের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। শিল্প মন্ত্রণালয় এই নীতিমালার খসড়া তৈরি করে মতামতের জন্য বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে।
খসড়ায় বলা হয়েছে, ইলেকট্রিক ভেহিকেলের কারণে দেশের জনগণ সাশ্রয়ী মূল্যে যানবাহন পাবে। নতুন রপ্তানি খাত তৈরি হবে ও জ্বালানি আমদানিতে সাশ্রয় হবে। ব্যবহার, চার্জিং রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে যথাযথ অবকাঠামো তৈরি না করেই ইলেকট্রিক যান কেনার এই শর্ত বাস্তবায়ন করা কঠিন হবে। বিশেষ করে চার্জিং স্টেশন এবং দক্ষ টেকনেশিয়ান ছাড়া ইলেকট্রনিক গাড়ি কেনা হলেও সেগুলো ব্যবহার করা যাবে না।
বুয়েটের শিক্ষক পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. হাদিউজ্জামান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ইলেকট্রিক ভেহিকেল নিয়ে সরকার নীতিমালা করছে- ভালো কথা; কিন্তু সেটি যেন টেকসই ও সমন্বিত নীতিমালা হয় সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। তিনি বলেন, দেশে সড়কের তুলনায় এমনিতেই যানবাহন অনেক বেশি। গাড়ির লাইফটাইম নাই। ফলে পুরোনো গাড়ি তুলে নিয়ে যাতে নতুন গাড়ি নামানো হয়- সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। চার্জিং স্টেশনে প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ সরবরাহ করার মতো সক্ষমতা রয়েছে কি-না দেখতে হবে। এ ছাড়া ইঞ্জিনচালিত গাড়ির চেয়ে ইলেকট্রনিক গাড়ির মেইনটেন্যান্স ভিন্ন। ফলে এ ধরনের যান রাস্তায় নামানোর আগে দক্ষ টেকনেশিয়ান গড়ে তুলতে হবে। নয়তো রাস্তায় গাড়ি পড়ে থাকবে, সাড়ানোর লোক পাওয়া যাবে না।
শিল্প মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, খসড়া নীতিমালায় ইলেকট্রনিক ভেহিকেল শিল্পের উন্নয়নে চার্জিং স্টেশন এবং ব্যাটারি উৎপাদনে শুল্কছাড়সহ প্রণোদনা সুবিধা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। মতামত পেলে এ ক্ষেত্রে আরও নতুন বিষয় সংযোজনের সুযোগ রয়েছে।
থাকছে নগদ ও ভর্তুকি সুবিধা : খসড়া নীতিমালায় ইলেকট্রিক যান শিল্পে শুল্কছাড়, ভর্তুকি, নগদ প্রণোদনাসহ একগুচ্ছ প্রণোদনার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ইঞ্জিন গাড়ি স্ক্র্যাপিং করে বৈদ্যুতিক গাড়ির সঙ্গে প্রতিস্থাপন করলে বিশেষ প্রণোদনা সুবিধা দেওয়া হবে; ইলেকট্রিক যান কেনার জন্য ব্যাংকঋণ সীমা নতুন গাড়ির ক্ষেত্রে ৬০ শতাংশে উন্নীত করা হবে; এ শিল্পে বন্ডেড ওয়্যার হাউস সুবিধা প্রদানসহ গাড়ি ও যন্ত্রাংশ রপ্তানিকে উৎসাহিত করতে নগদ ও ভর্তুকি সুবিধা দেওয়া হবে; ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্প উন্নয়নে দেওয়া হবে আর্থিক প্রণোদনা ও নীতি সহায়তা; ইলেকট্রিক ভেহিকেল শিল্প উন্নয়নে একটি ‘রিসার্স অ্যান্ড ইনোভেশন সেন্টার’ গড়ে তোলা হবে; মোটরযান চলাচলে লাইফটাইম নির্ধারণ করা হবে; কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ইলেকট্রিক ভেহিকেল বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হবে এবং ইলেকট্রিক যানবাহনের পাশাপাশি বহুল জনপ্রিয় বিশেষ আকারের চার ও তিন চাকার ইলেকট্রিক বাহনগুলোকেও রেজিস্ট্রেশনের আওতায় আনা হবে।
চার্জিং স্টেশন স্থাপনে বেসরকারি খাতকে প্রণোদনা : ইলেকট্রিক ভেহিকেল ব্যবহারে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে পর্যাপ্ত চার্জিং পয়েন্ট স্থাপন করা। নীতিমালায় চার্জিং স্টেশন স্থাপনে বেসরকারি খাতকে বিশেষ প্রণোদনা দেওয়ার কথা উল্লেখ রয়েছে। ইভি চার্জিং স্টেশন স্থাপনকারী ও যন্ত্রাংশ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান আগামী ১০ বছরের আয়কর অব্যাহতি সুবিধা পাবে; ইলেকট্রিক মোটরযানের চাহিদার ভিত্তিতে বিদ্যুৎ বিভাগ প্রয়োজনীয় চার্জিং স্টেশন স্থাপনের উদ্যোগ নেবে; এ ছাড়া পাবলিক চার্জিং স্টেশন স্থাপনে সরকারি প্রণোদনা ও শহরে ইভি পার্কিং এবং চার্জিং স্টেশন স্থাপনে বিল্ডিং নির্মাণ কোড সংশোধন করা হবে; সরকারি-বেসরকারি ফুয়েল ডিস্ট্রিবিউটর কোম্পানিগুলোর মাধ্যমে ইভি চার্জিং স্টেশন স্থাপনে মন্ত্রণালয় ব্যবস্থা নেবে।
ব্যাটারি উৎপাদনে শুল্ক ও ভ্যাট ছাড় : দেশি ইলেকট্রিক যান ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ পণ্য হিসেবে দেশীয় উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান লেড ব্যাটারি, লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারি উৎপাদনে পাবে শুল্কছাড় সুবিধা। এ ছাড়া ইলেকট্রিক যানের জন্য লিথিয়াম ব্যাটারি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্থানীয়ভাবে বাজারজাত ও বিক্রির ক্ষেত্রে ভ্যাট অব্যাহতিও দেওয়া হবে। ইলেকট্রিক ভেহিকেল শিল্প উন্নয়নে শিল্প মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বা উপদেষ্টাকে প্রধান করে একটি কাউন্সিল গঠন করা হবে। নীতিমালা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে শিল্প সচিবকে প্রধান করে একটি বাস্তবায়ন কমিটি করা হবে। এই নীতিমালার আলোকে ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত ইলেকট্রিক ভেহিকেল শনাক্তকরণ এবং ২০২৬ সাল থেকে রেজিস্ট্রেশন নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে।