শোবিজ জগৎ থেকে একের পর এক গুণী অভিনয়শিল্পী, নির্মাতা ও কলাকুশলীর মহাপ্রয়াণ। ইন্ডাস্ট্রিতে সৃষ্টি হচ্ছে অপূরণীয় শূন্যতা, যা কার্যত এটিকে করে তুলেছে অভিভাবকহীন। এ ক্ষতি পুরো শিল্পের জন্য অশনিসংকেত। সময়ের পালাবদলে হারিয়ে যাওয়া সেই কিংবদন্তিদের নিয়ে এই বিশেষ প্রতিবেদনটি লিখেছেন- পান্থ আফজাল
এ দেশের টেলিভিশন নাটক, চলচ্চিত্র ও সংগীতাঙ্গনের ছিল এক সুন্দর ও সোনালি অতীত। সে সময়ের নাটক মানেই ছিল তুমুল জনপ্রিয়তা, আর প্রতিটি চলচ্চিত্র যেন একেকটি ‘মাস্টারপিস’। সংগীতাঙ্গনও ছিল নানারকম কালজয়ী গানে মুখর। নাটকের জন্য রাজপথে মিছিল হওয়ার ঘটনাও দেখিয়েছে এই ইন্ডাস্ট্রি। কী সুন্দর নাম, গল্প, সংলাপ আর অভিনয়ের শৈলীতে সমৃদ্ধ ছিল সেই সময়ের শিল্পকর্ম! সোনালি সময় থেকে শুরু করে নব্বই-পরবর্তী সময় পর্যন্ত অসংখ্য মানসম্মত নাটক-চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। দর্শক খুঁজে ফিরেছে তাদের হাসি-কান্না ভরা মুহূর্ত। কনটেন্ট ছিল মানসম্মত; একক কিংবা ধারাবাহিকের মতো প্রতিটি চলচ্চিত্রও ছিল যেন অমর সৃষ্টি। সে সময় স্ক্রিপ্ট ছিল খুবই শক্তিশালী এবং অভিনয় ছিল মানসম্মত। গানের জগতে একক গানের পাশাপাশি ব্যান্ড দলগুলোও জনপ্রিয় গান নিয়ে অ্যালবাম প্রকাশ করত, কনসার্ট করত। মানুষ মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনত প্রিয় শিল্পী, সুরকার ও গীতিকারের সৃষ্টি। নাটক-চলচ্চিত্রে প্রিয় অভিনয়শিল্পীদের দেখার জন্য অপেক্ষা করত। সে সময় যাঁরা এই শোবিজ জগতে এসেছিলেন, তাঁদের অনেকেই পেয়েছিলেন আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা, যার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত প্রয়াত নায়ক সালমান শাহ। অন্যদিকে আশির দশকে হুমায়ূন আহমেদের নাটকগুলো নাট্যজগতে এক বিপ্লব এনেছিল, যার মধ্য দিয়ে তৈরি হয়েছিল বিশাল সংখ্যক দর্শক।
কিন্তু সময়ের নির্মম স্রোতে একের পর এক গুণীজন হারিয়ে যাওয়ায় আজ এই শিল্পাঙ্গন এক গভীর শূন্যতার মুখোমুখি। ‘আজ রবিবার’ নাটকে আবুল খায়ের অথবা আলী যাকেরের অভিনয় প্রমাণ করে একটি চরিত্র কতটা আপন হতে পারে, আজ সেই দুই নাট্যজনই নেই। নেই হুমায়ুন ফরীদির মতো শক্তিমান অভিনেতা, নেই প্রিয় শিল্পী সুবীর নন্দী (২০১৯)। বিটিভির কালজয়ী ধারাবাহিক ‘সংশপ্তক’-এর বড় মালু চরিত্রে অভিনয় করে ব্যাপক সাড়া ফেলা ধ্রুপদী যোদ্ধা মুজিবুর রহমান দিলুও (২০২০) পাড়ি জমিয়েছেন মহাপ্রস্থানে। ২০২১ সালে আমরা হারালাম একুশে পদকপ্রাপ্ত অভিনেতা-নাট্যকার নাট্যজন ড. ইনামুল হককে এবং বরেণ্য চিত্রনায়িকা কবরীকে। ‘কোথাও কেউ নেই’-এর বাকের ভাইয়ের সঙ্গী বদি চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় করা আবদুল কাদেরের অনুপস্থিতিতেও আজ নাটকের ইন্ডাস্ট্রি শূন্য।
আজ নাট্যাঙ্গনে সেই দীপ্ত পদচারণ নেই গোলাম মুস্তাফা, আবদুল্লাহ আল মামুন, সৈয়দ আলী আহসান সিডনী, মমতাজ উদ্দিন আহমেদ, এস এম মহসীন, কে এস ফিরোজ, চ্যালেঞ্জার, সালেহ আহমেদ, মাহমুদা খাতুন, খালেদ খান, মোজাম্মেল হক, রওশন জামিল, নাজমা আনোয়ার, মিনু মমতাজ, মোস্তফা কামাল সৈয়দ, মোহাম্মদ বরকত উল্লাহ, এ টি এম শামসুজ্জামানের মতো সব্যসাচী গুণী অভিনেতাদের। ২০২২ সালের ১৭ অক্টোবর একুশে পদকপ্রাপ্ত বরেণ্য অভিনেতা মাসুম আজিজ এবং ৪ সেপ্টেম্বর কিংবদন্তি গীতিকার, পরিচালক ও বহু কালজয়ী গানের স্রষ্টা গাজী মাজহারুল আনোয়ারও চলে গেছেন না-ফেরার দেশে। এ বছর আরও পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছেন সুরকার আলম খান, অভিনেত্রী শর্মিলী আহমেদ, আকবর, প্রযোজক-নির্মাতা আজিজুর রহমান, আজিজুর রহমান বুলি, গীতিকার কে জি মোস্তফাসহ অনেক গুণী মানুষ। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে মারা যান ‘ঘুড্ডি’ খ্যাত নির্মাতা সৈয়দ সালাহউদ্দিন জাকী, ১৮ অক্টোবর চলচ্চিত্র নির্মাতা শফি বিক্রমপুরী এবং ২০ সেপ্টেম্বর গুণী নৃত্যশিল্পী ও অভিনেত্রী জিনাত বরকতুল্লাহ। শোবিজ অঙ্গনের অনেককেই আমরা ২০২৪ সালে হারিয়েছি। এ তালিকায় আছেন গীতিকবি জাহিদুল হক, অভিনেতা আহমেদ রুবেল, রবীন্দ্র সংগীতশিল্পী সাদি মহম্মদ, ব্যান্ড তারকা শাফিন আহমেদ, ব্যান্ড শিল্পী খালিদ, অভিনেতা অলিউল হক রুমি, রবীন্দ্র সংগীতশিল্পী পাপিয়া সারোয়ার, কণ্ঠশিল্পী হাসান আবিদুর রেজা জুয়েল, মনি কিশোর, অভিনেতা মাসুদ আলী খান, সুরকার সংগীত পরিচালক সুজেয় শ্যাম, অভিনেতা জামাল উদ্দিন হোসেন, গীতিকবি আবু জাফর, নির্মাতা সি বি জামান, মাসুদ আলী খানসহ আরও অনেকেই। এদিকে এ বছরের ১৩ সেপ্টেম্বর লোকসংগীতের বরেণ্য শিল্পী ফরিদা পারভীন পরপারে পাড়ি জমান। তার বয়স হয়েছিল ৭৩ বছর। তিনি দীর্ঘদিন ধরে কিডনি জটিলতায় ভুগছিলেন।
একসময় এই চলচ্চিত্র-নাটকে সদর্পে অভিনয় করেছেন ফেরদৌসী মজুমদার, রাইসুল ইসলাম আসাদ, আমিরুল হক চৌধুরী, দিলারা জামান, নিমা রহমান, আবুল হায়াত, সারা যাকের, মামুনুর রশীদ, লাকী ইনাম, পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়, ডলি জহুর, তারিক আনাম খান, আফজাল হোসেন, সুবর্ণা মুস্তাফা প্রমুখ। তাঁদের মধ্যে অনেকেই এখনো শিল্পের বাতি জ্বালিয়ে রেখেছেন। কিন্তু সুভাষ দত্ত, সত্য সাহা, নায়করাজ রাজ্জাক, নায়ক ফারুকের মতো গুণীজনশূন্য এখন এই মিডিয়া ইন্ডাস্ট্রি।
একইভাবে প্লেব্যাক সিঙ্গার হিসেবে যাঁরা নিয়মিত গানে মুগ্ধতা ছড়াতেন সেই আজম খান, এন্ড্র্রু কিশোর, আবদুল জব্বার, লাকী আখন্দ, বশীর আহমেদ, মাহমুদুন নবী, নীলুফার ইয়াসমিন, আইয়ুব বাচ্চুসহ অনেক গুণী শিল্পীও প্রয়াত। সংগীতজ্ঞ আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল, রবিন ঘোষসহ অনেকেই নেই আজ। আর যাঁরা বেঁচে আছেন, তাঁদের যথাযথ মূল্যায়নও যেন কমছে এই ইন্ডাস্ট্রিতে।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে, উত্তরসূরিদের পথ ধরে যাঁরা মিডিয়ায় এসেছেন তাঁদের অনেকের কাজ নিয়েই দর্শকদের মাঝে আগ্রহ কম। এখন তো জনপ্রিয়তা পাওয়ার জন্য নাটকের যাচ্ছেতাই নাম রাখা হচ্ছে। দর্শক দেশের টেলিভিশন চ্যানেলগুলো থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। নিম্নমানের গল্প, উদ্ভট ও অশ্লীল সংলাপ, নতুনদের বিরক্তিকর অপেশাদারি অভিনয়, নির্মাতাদের আনাড়ি নির্মাণের পাশাপাশি ইদানীং যোগ হয়েছে নাটকের উদ্ভট সব নাম, ভিউ ধরতে অসামঞ্জস্য ইংরেজি নাম ও পোস্টারের ব্যবহার। সেই অর্থে নাটকের মানের দিকে কোনো খেয়াল নেই কারও। একই দশা দেশের চলচ্চিত্র ও ওটিটি প্ল্যাটফর্মের। সব মিলিয়ে এই কিংবদন্তি ও অভিভাবকস্থানীয় ব্যক্তিত্বদের প্রয়াণের ফলে সৃষ্ট শূন্যতা এবং চলমান নিম্নমুখী মান, উভয় কারণেই শোবিজ ইন্ডাস্ট্রি এক চরম দুর্দশায়। এ অভিভাবকশূন্যতায় যে অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে, তা থেকে উত্তরণের পথ খুঁজে বের করা আজ সময়ের দাবি। এভাবে চললে আমাদের ঐতিহ্যবাহী শোবিজ জগৎ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? এ নিয়ে এখনই গভীর ভাবনা জরুরি।