জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ও গণভোট নিয়ে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। রাজনৈতিক দলগুলোও জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ইস্যুতে পরস্পরবিরোধী অবস্থান নিয়েছে। প্রায় সব দল সরকারের বিরুদ্ধে চলে গেছে। এ অবস্থায় ফেব্রুয়ারিতে সরকার ঘোষিত সংসদ নির্বাচন হবে কি না এ নিয়ে জনমনে সংশয় দিনদিন বাড়ছে।
কিন্তু রাজনৈতিক দলের কর্মী-সমর্থকের বাইরে সচেতন সাধারণ মানুষ চায় দ্রুত নির্বাচন। বিশাল এ জনগোষ্ঠী বলছে, গত ১৫ বছরে ভোটাধিকার খর্ব হয়েছে। বিগত সময়ের নির্বাচনে দিনের ভোট রাতে, জালভোট, কেন্দ্র দখল আর খুনের ঘটনাও ছিল। নির্বাচিত সরকার না থাকায় দেশের ব্যবসাবাণিজ্য থেকে শুরু করে আইনশৃঙ্খলা কোনো কিছুই সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। তারা চলতি বছরের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন চায়।
নির্বাচন সামনে রেখে উদ্গ্রীব সাধারণ ভোটাররা। তারা অপেক্ষা করছে একটি সুষ্ঠু, সুন্দর ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের। শিক্ষার্থী থেকে শ্রমজীবী, নতুন ভোটার থেকে আবালবৃদ্ধ-পেশাজীবী সবাই একটি ভোটের উৎসবের দিন গুনছে। সাধারণ মানুষের দাবি সব সংকট সমাধানে সবার আগে দ্রুত জাতীয় নির্বাচন। নিট পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ নিট পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা কেন, নির্বাচিত সরকার সবাই চায়। নির্বাচিত সরকার না থাকায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া যাচ্ছে না।’
বাংলাদেশ গার্মেন্ট অ্যাকসেসরিজ অ্যান্ড প্যাকেজিং ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএপিএমইএ) সভাপতি মো. শাহরিয়ার বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচিত সরকার চায়। নির্বাচিত সরকার ছাড়া ব্যবসাবাণিজ্যে স্থিতিশীলতা আসবে না। নির্বাচিত সরকার না থাকায় বায়াররা আমাদের এখানে অর্ডার করতে চান না। এজন্য আমাদের ২৫ শতাংশের বেশি অর্ডার অন্যান্য দেশে চলে যাচ্ছে। নির্বাচিত সরকার না থাকায় প্রশাসন ও কাস্টমসে নানান সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। স্থানীয় রাজনৈতিক বিভিন্ন ছোটবড় দল এখন ঝুট ব্যবসা নিয়ে কারখানায় গিয়ে সমস্যা তৈরি করে। নির্বাচিত সরকার এলে এ যন্ত্রণা থেকে ব্যবসায়ীরা মুক্তি পাবেন।’
আবাসন খাতের শীর্ষ সংগঠন রিহ্যাবের প্রথম সহসভাপতি এম এ আউয়াল বলেন, ‘নির্বাচিত সরকার না থাকায় ব্যবসাবাণিজ্যে বিনিয়োগে স্থবিরতা বিরাজ করছে। ব্যবসায়ীরা আতঙ্কে রয়েছেন। দেশিবিদেশি কোনো বিনিয়োগ নেই বললেই চলে। সবাই হাত গুটিয়ে বসে আছেন। দুশ্চিন্তায় ব্যবসায়ীরা। ম্যানুফ্যাকচারিং, রিয়েল এস্টেট, ব্যাংকিং ও সেবা খাতে নতুন বিনিয়োগ এখন প্রায় বন্ধ। নির্বাচিত সরকার ছাড়া দায়বদ্ধতা ও নীতির ধারাবাহিকতা অনিশ্চিত। নির্বাচিত সরকার ছাড়া ব্যবসায় এখন ঝুঁকি নেওয়ার সময় নয়। সব সংকটের একমাত্র সমাধান জাতীয় নির্বাচন।’
রাজধানীর শনিরআখড়ায় বসবাসকারী ব্যবসায়ী আবদুল হান্নান বলেন, ‘নির্বাচিত সরকার না থাকায় ব্যবসায় নানান সমস্যা হচ্ছে।’ তাঁর মত, অনেক ব্যবসায়ী নির্বাচিত সরকারের অপেক্ষায় দিন গুনছেন।
সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতির তরুণ সদস্য রণেন সরকার রনি দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে আপাতত হতাশা জানিয়ে বলেন, ‘জুলাই আন্দোলনের মাধ্যমে স্বৈরাচারের পতনের পর যে রকম গণতান্ত্রিক পরিবেশ আমরা প্রত্যাশা করেছিলাম, তার কিছুই হয়নি। ভবিষ্যৎ নিয়ে খুবই হতাশ।’ তিনি বলেন, ‘দ্রুত জাতীয় নির্বাচন চাই। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন চাই। যেখানে বিনা বাধায়, নির্বিঘ্নে মানুষ ভোটাধিকার প্রয়োগ করবে।’
প্রথমবার ভোট দেওয়ার অপেক্ষায় আছেন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সুজয় শুভ। তাঁর ভাষায়, ‘আমাদের জন্য ভোট শুধু একটি অধিকার নয়, বরং ভবিষ্যৎ গড়ার হাতিয়ার।’ শুভ চান প্রার্থী হোক সৎ, শিক্ষিত ও জনবান্ধব। ‘আমরা চাই জনগণের প্রতিনিধি।’
চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি কলেজের বাংলা বিভাগের শিক্ষক মোহাম্মদ শাহজাহান বলেন, ‘দ্রুত অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ এবং দেশে-বিদেশে গ্রহণযোগ্য হবে সে রকম একটি মডেল নির্বাচন আশা করছি।’ তিনি বলেন, ‘সুষ্ঠু ভোটের মাধ্যমে হত্যা, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও রাজনৈতিক হানাহানিমুক্ত এবং বৈষম্যহীন সমাজ-রাষ্ট্রব্যবস্থা চাই।’ নগরের আলকরণ এলাকার বাসিন্দা যুবক আমজাদ হোসেন বলেন, ‘নতুন ভোটার হওয়ার পর তিনটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও ভোট দিতে পারিনি। এবার প্রথম ভোট দেব। ভোট দিয়ে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত করার আনন্দই আলাদা। আমরা ভোট দিতে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি।’
খুলনা বেসরকারি সংস্থার কর্মী পলাশ হোসেন চান বলেন, ‘২০০৮ সাল থেকে চারটি জাতীয় নির্বাচন স্বচ্ছ ও সাবলীল ছিল না। দ্রুত জাতীয় নির্বাচন চাই।’
ময়মনসিংহের বাদ্যযন্ত্র বিক্রেতা রেজাউল করিম আসলাম এবারের নির্বাচন নিয়ে মানুষের আগ্রহ বেশি জানিয়ে বলেন, ‘মানুষ দেখতে চায় নির্বাচন কেমন হয়। সরকারের কথা ও কাজে মিল আছে কি না।’
রাজশাহী কলেজের স্নাতকের শিক্ষার্থী নাইম ইসলাম বলেন, ‘বৈষম্যবিরোধী দেশ গড়তে জুলাই গণ অভ্যুত্থানের সৃষ্টি হয়েছে। আমরা নতুন করে দেশ গড়ার প্রত্যয় বুকে লালন করি। দেশকে নতুন করে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখি। সেই দিক থেকে নতুন নেতৃত্বই চাই আমরা।’ দ্রুত নির্বাচনের দাবি জানান তিনি।
রাজশাহী মহানগরীর কাদিরগঞ্জের তরুণ ভোটার নেওয়াজ আহমেদ বলেন, ‘দ্রুত একটি সুষ্ঠু-সুন্দর এবং উৎসবমুখর নির্বাচন দেখতে চাই আমরা।’ তিনি বলেন, ‘পেশিশক্তির ব্যবহার হবে না এমন নির্বাচন চাই আমরা। মানুষ যেন স্বাধীনভাবে কেন্দ্রে যেতে পারে, সেই পরিবেশ দেখতে চাই।’
রংপুরের তরুণ পেশাজীবী নজরুল ইসলাম বলেন, ‘সাধারণ ও প্রান্তিক ভোটারের প্রত্যাশা একটি সুষ্ঠু, স্বচ্ছ ও প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন হবে। জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী সরকার আগে জাতীয় নির্বাচনের উদ্যোগ নেবে এমনটাই প্রত্যাশা করি।’
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, টানা ১৫ বছর শাসন-শোষণের পর আওয়ামী লীগের বিদায় জনমনে স্বস্তি এনেছে। মানুষের চাওয়াপাওয়ার একটা জায়গা তৈরি হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার সে জায়গাটায় আছে। যারপরনাই বাংলাদেশের মানুষ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে একটা নির্বাচনের জন্য। অন্তর্বর্তী সরকার একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রণমূলক নির্বাচন উপহার দেবে সে আশায় বুক বেঁধে আছে গোটা জাতি। নির্বাচনের জন্য সাধারণ মানুষ সরকার ঘোষিত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অপেক্ষা করতে চায় না। তারা দ্রুত জাতীয় সংসদ নির্বাচন চায়। গত মার্চে ইননোভিশন নামে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ‘জনগণের নির্বাচন ভাবনা’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাতে দেখা যায়, চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে ৫৮ শতাংশ মানুষ নির্বাচন চায়। বিশেষ করে যারা নতুন ভোটার তারা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। জীবনের প্রথম ভোট বলে কথা। ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবে চিন্তা করেই তাদের আনন্দের সীমা নেই। মাত্র কয়েক দিন পরই তারা প্রথমবারের মতো ভোটাধিকার প্রয়োগ করবে। দেশের নাগরিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে। নাগরিক মর্যাদার আসনে আসীন হবে। এসব চিন্তা করে নতুন ভোটার প্রজন্ম স্বপ্নে বিভোর।
কিন্তু জুলাই সনদ ইস্যুতে জটিলতার আশঙ্কা করে সাধারণ মানুষ বলছে, ভোটাধিকার নাগরিকের মৌলিক অধিকার। এ অধিকার থেকে সরকার বা রাষ্ট্র কেউ তাকে বঞ্চিত করার বা রাখার অধিকার রাখে না। তারা বলছে, সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন দিতে হবে। নির্বাচনে তারা ভোটাধিকার প্রয়োগ করবে। পছন্দমতো প্রার্থীকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করবে। দেশের শাসনভার প্রকৃত শাসকের হাতে তুলে দেবে।
সচেতন সাধারণ মানুষ বলছে, গণভোট জাতীয় নির্বাচনের আগে নাকি একই দিনে, এ আলোচনাটিই নিরর্থক। কেননা বাংলাদেশে অতীতে যে তিনটি (১৯৭৭, ১৯৮৫, ১৯৯১) গণভোট হয়েছে, সেগুলোর অভিজ্ঞতা বলছে, এ ভোটে জনগণের মতামতের কোনো প্রতিফলন ঘটে না। বরং ক্ষমতাসীনরা যা চায়, যেভাবে চায় এবং যে ফলাফল চায় গণভোটে তা-ই হয়। জাতীয় নির্বাচনের আগে জুলাই সনদের ওপর গণভোট হলে তার ফলাফল কী হবে, সহজেই অনুমেয়। দ্বিতীয়ত জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে একই দিনে গণভোট হলে সেটি আরেকটি জটিলতার সৃষ্টি করবে। কেননা জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট সম্পূর্ণ আলাদা দুটি বিষয়। তারা বলছে, জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোটের আয়োজন করা হলে জাতীয় নির্বাচনের সমপরিমাণ অর্থের প্রয়োজন হবে। গণভোটের পর ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন সম্ভব নয়। তা ছাড়া গণভোটে জটিলতার সৃষ্টি হলে জাতীয় নির্বাচন অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। তাই তাদের দাবি, সবার আগে জাতীয় নির্বাচন।