২৯ জুন, ২০২২ ২০:৫৫

ব্যক্তির গভীর নলকূপে সংকট বাড়ছে বরেন্দ্র এলাকায়

নিজস্ব প্রতিবেদক, রাজশাহী

ব্যক্তির গভীর নলকূপে সংকট বাড়ছে বরেন্দ্র এলাকায়

ঠাঁ ঠাঁ বরেন্দ্র এখন দেশের অন্যতম শস্য ভাণ্ডার। তবে এর শুরুটা বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) ভূ-গর্ভস্থ পানির সেচে। তখনই শুরু সর্বনাশের। সংকট টের পেতে বিএমডিএর কেটে যায় প্রায় তিন যুগ। বিএমডিএ পিছু হটলেও পানি তুলতে নেমে পড়ে প্রভাবশালীরা। পানি নিয়ে এই বাণিজ্য সংকট আরও বাড়াচ্ছে।

বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএমডিসি) ক্ষুদ্র সেচ সমীক্ষা প্রতিবেদন ২০১৯-২০ অনুযায়ী, রাজশাহী, নওগাঁ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় মোট সেচ পাম্প আছে ১ লাখ ৪ হাজার ৮৫৮টি। এর মধ্যে বিএমডিএর ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হয় ৮ হাজার ৫২৫টি। বাকি ৯৬ হাজার ৩৩৩টি পাম্প চলছে ব্যক্তি মালিকানায়।

এই তিন জেলার ৫ লাখ ৭ হাজার ১৪৫ হেক্টর জমি সেচের আওতায় এসেছে। এর মধ্যে বিএমডিএ সেচ দিচ্ছে ২ লাখ ৯৫ হাজার ৭৬১ হেক্টর জমিতে। বাকি ২ লাখ ১১ হাজার ৩৮৬ হেক্টর জমিতে সেচ দিচ্ছে ব্যক্তিগত সাবমার্সিবল পাম্প (এসটিডাব্লিউ) থেকে।

ওই প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি ৫৩ হাজার ৯২৩টি ব্যক্তি মালিকানায় পাম্প আছে নওগাঁয়। এই জেলার সেচের ৫১ শতাংশ তাদের দখলে। বাকি ৪৯ শতাংশ জমি সেচ পাচ্ছে বিএমডিএর সেচ পাম্প থেকে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ-রাজশাহীতেও একই চিত্র। রাজশাহীতে ২ হাজার ৮৫২টি বিএমডিএর পাম্প চললেও এসটিডাব্লিউ চলছে ২৭ হাজার ১০৫টি। চাঁপাইনবাবগঞ্জের ১  হাজার ৫৮৩টি বিএমডিএর পাম্পের পাশাপাশি ১৫ হাজার ৩১৫টি এসটিডাব্লিউ চলছে।

সংশ্লিষ্ট একাধিক নথি বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ষাটের দশকের প্রথম দিকে দেশে সেচের জন্য গভীর নলকূপ বসানো শুরু। ১৯৭১ সালের জানুয়ারিতে বৃহত্তর রাজশাহী জেলায় (রাজশাহী, নওগাঁ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ) এক হাজার গভীর নলকূপ স্থাপনের সুপারিশ করে গবেষণা সংস্থা জিও টেকনিকা যুগোশ্লাভিয়া। কিন্তু এই পরিকল্পনা থেকে বাদ দেওয়া হয় বরেন্দ্র ভূমির প্রায় ৭৫০ বর্গমাইল এলাকা। এর দুই বছর পর ১৯৭৩ সালে আইডিএ প্রকল্পের মাধ্যমে ৩ হাজার গভীর নলকূপ স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। একই কারণে এই অঞ্চলটি বাদ পড়ে যায়।

১৯৮২ সালে ইউএনডিপি প্রকাশিত কারিগরি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বরেন্দ্র জোনকে জিরো এক্যুইফার হিসাবে দেখানো হয়। তাতে উল্লেখ করা হয়, জিরো ইক্যুফারে ৩০০ মিটার (৯৮০ ফিট) গভীরতার মাঝে গভীর নলকূপের সাহায্যে তোলার মত পানি নেই। যদি কিছু থেকে থাকে তা গৃহস্থালির প্রয়োজন মেটানোর জন্য যথেষ্ট। 

এরপর ১৯৮৫ সালে বিষয়টি নিয়ে সমীক্ষা চালায় পানি উন্নয়ন বোর্ড। সংস্থাটি কারিগরি প্রতিবেদনে জানায়, শুধুমাত্র হস্তচালিত গভীর নলকূপে বরেন্দ্র অঞ্চলের ভূ-গর্ভ থেকে পানি তোলা সম্ভব। ওই বছরই বরেন্দ্র সমন্বিত এলাকা উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে রাজশাহী, নওগাঁ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় গভীর নলকূপ বসানো শুরু হয়। প্রকল্পটির লক্ষ্য ছিল, পুরো বরেন্দ্র অঞ্চলের ২ লাখ ২৫ হাজার একর জমি সেচের আওতায় নিয়ে আসা। যাতে ফসলের নীবিড়তা ১১৭ শতাংশ থেকে বেড়ে ১৭৬ শতাংশে উন্নীত হয়। এই প্রকল্পটি এক পর্যায়ে বিএমডিএতে স্থায়ী রূপ পায়। বর্তমানে ১৫ হাজার ৫৫৩টি গভীর নলকূপে পানি তুলছে বিএমডিএ।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক চৌধুরী সারওয়ার জাহান সজল বলেন, পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনায় যেসব প্রতিষ্ঠান কাজ করে তাদের মধ্যে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। দেশের একমাত্র তিন ফসলি জমি বরেন্দ্র অঞ্চলেই। এখানে সেচের ক্ষেত্রে নানান চ্যালেঞ্জ আছে। জাতীয় গড় বৃষ্টিপাতের প্রায় অর্ধেক কম বৃষ্টিপাত হয় এ এলাকায়। একবার বৃষ্টি হলে দীর্ঘকালীন খরা যায়। হলে ফসল বাঁচাতে কৃষকদের প্রচুর ভূ-গর্ভস্থ পানি তুলতে হয়। এজন্যই ভূ-গর্ভস্থ পানির উপর চাপ পড়ে। 

বরেন্দ্রজুড়ে পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনায় সম্ভাব্যতা যাচাই চলছে। এই কমিটির সদস্য অধ্যাপক চৌধুরী সারওয়ার জাহান সজল। তিনি বলেন, একটি স্তর এর নিচে আর কোন পানির স্তর আছে কিনা সেটি সমীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। কোনো এলাকাকে পানি সংকটাপন্ন ঘোষণা করতে হলে পর্যাপ্ত তথ্য এবং গবেষণা প্রয়োজন। সেই গবেষণা এখন চলমান। 

বিধি-নিষেধের কারণে বিএমডিএ আর গভীর নলকূপ বসাচ্ছে না। কিন্তু ব্যক্তিগত উদ্যোগ থামানো যাচ্ছে না। সরকার উদ্যোগ নিয়েছে, কিন্তু সফল হয়নি। এর সঙ্গে রাজনৈতিক প্রভাব জড়িত। বিষয়টি স্বীকার করেছেন বিএমডিএর নির্বাহী পরিচালক আবদুর রশিদ। তিনি বলেন, ভূ-গর্ভস্থ সেচ বরেন্দ্র শুরু করেছিল ঠিকই, কিন্তু প্রযুক্তি স্থানান্তর হয়ে গেছে। সেচের গুরুত্ব বাড়ায় ব্যক্তি মালিকানায় ছোট গভীর নলকূপ বসানো হচ্ছে। বরেন্দ্রের সেচ এলাকায় প্রচুর পরিমাণে এমন গভীর নলকূপ বসানো হয়েছে। এটা কোনোভাবে থামানো যাচ্ছে না। 

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা ভূ-উপরস্থ সেচ কার্যক্রম সম্প্রসারণ করেছি। পদ্মা মহানন্দা আত্রাই নদীর পানি তুলে সেচের কাজে লাগানো হচ্ছে। বৃষ্টির পানি আহরণে বড় বড় পুকুর-দীঘি এবং খাল পুর্নখনন হচ্ছে। আমরা চেষ্টা করছি ধীরে ধীরে ভূ-উপরিস্থ সেচের পরিধি বাড়ানোর।’

বিডি প্রতিদিন/আবু জাফর

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর