চা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ন্যূনতম ৩০০ টাকা করার দাবিতে সংহতি সমাবেশ করেছে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন গৌরব ’৭১। আজ শনিবার বেলা ১১টায় শাহবাগ প্রজন্ম চত্বরে এই সমাবেশ হয়।
এতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও সামাজিকবিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন ড. সাদেকা হালিম বলেন, ‘গত ৯ আগস্ট থেকে চা শ্রমিকরা তাদের মজুরি ১২০ থেকে বাড়িয়ে ৩০০ টাকা করার দাবিতে আন্দোলন করছেন। গতকাল আমরা দেখেছি, একটি নির্মম ঘটনাও ঘটেছে। শ্রীমঙ্গলে একটি উপজেলায় চারজন চা শ্রমিক মাটি কাটতে গিয়ে নিহত হয়েছেন। অর্থাৎ তাদের জীবন কতটা মর্মান্তিক- এই ঘটনা আমাদের মনের মধ্যে একটি গভীর ক্ষত তৈরি করেছে।’
তিনি বলেন, ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু সবসময় অবহেলিতদের পক্ষে কথা বলেছেন। এমনকি তিনি পঁচাত্তর পূর্ববর্তী সময়ে যেসব নীতিমালা করেছেন, সকলক্ষেত্রে তিনি জনগণের কথাই বলেছেন।’
‘এই যে আমরা প্রতিনিয়ত চা পর্যটন শিল্প দেখতে যাচ্ছি। এটার ইতিহাস আছে। ঔপনিবেশিক যুগ থেকে চা শ্রমিকরা বংশ পরম্পরায় এখানে কাজ করেন। ব্যক্তিগতভাবে তাদের সাথে আমার মেশার সুযোগ হয়েছে। আমি দেখেছি তারা ৮-১২ হাতের ছোট্ট কুঁড়ে ঘরের মধ্যে সন্তান-সন্ততি নিয়ে জীবনযাপন করছেন। তারপরও তারা কোনো অংশেই কম মেধাসম্পন্ন নন। কিন্তু যারা চা শিল্পের মালিক তারা সেই মধ্যযুগীয় মনোভাব পোষণ করেন এখনো। ১২০ টাকা মজুরি, এটি একরকম স্লেভারি (দাসত্ব)। অথচ এই চা শিল্পে আমরা পৃথিবীতে দশম স্থানে আছি।’
ড. সাদেকা হালিম আরও বলেন, ‘শ্রমিকরা বলেন- আমরা ভালো চা উৎপাদন করি, কিন্তু তা কালোবাজারিতে চলে যাচ্ছে। এখানে রাষ্ট্রের একটি দায়বদ্ধতা আছে। আজকে নারী শ্রমিকের সংখ্যা তুলনামূলক কমে গেছে। যখন নারী শ্রমিকদের আন্দোলন হয়েছিল, আমরা তাদের পাশে দাঁড়িয়েছি। তখন প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, শ্রমিকরা আটঘণ্টা কাজ করবে এবং তাদের ন্যূনতম মজুরি প্রধানমন্ত্রী নিজেই ঠিক করে দিয়েছেন। চা শ্রমিকরা উনার প্রতি আস্থা রেখেছেন। কিন্তু শ্রমিকরা আটঘণ্টার বেশি সময় ধরে কাজ করে যাচ্ছেন অতিরিক্ত মজুরি পাওয়ার জন্য। যার কারণে তারা বিভিন্ন রোগ-শোকে পড়ছেন, নানা শারীরিক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন।’
তিনি বলেন, ‘অনেকে বলেছেন, মানবিকভাবে তাদের মজুরি বাড়ানো হোক। আমি এই কথার সাথে একমত নই। এটা তাদের ন্যায্য দাবি। চা শ্রমিকরা যে এখন একতাবদ্ধ হয়েছেন, সেটা ভাঙারও একটা অপপ্রচেষ্টা করে যাচ্ছেন অনেকে। বিভিন্ন কনসালটেন্ট মিটিংয়ে দেখা যাচ্ছে, চা বাগানের মালিকরা বসে সেটাতে আধিপত্য বিস্তার করছেন। আমি সর্বোপরি চা শ্রমিকদের দাবির সাথে সংহতি প্রকাশ করে অবিলম্বে এই দাবি বাস্তবায়ন চাচ্ছি।’
ড. সাদেকা হালিম বলেন, ‘গতকাল রাতে ফেসবুকের এক পোস্টে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ এমপি চা শ্রমিকদের দাবি সহানুভূতির সাথে বিবেচনা করার জন্য চা বাগান মালিকদের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন। আমি হানিফ ভাইকে ধন্যবাদ জানাই।’
ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এস এস জাকির হোসাইন বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, পৃথিবী দুইভাগে বিভক্ত, একটি শোষক, আরেকটি শোষিত। আমি শোষিতের পক্ষে। আজকে একবিংশ শতাব্দীতে এসেও আমাদের বলতে হচ্ছে, আমরা শোষিতের পক্ষে।’
তিনি বলেন, ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চা শ্রমিকদের ভোটাধিকার দিয়েছিলেন। এর ফলস্বরূপ তারা শতভাগ ভোট আওয়ামী লীগকে দিয়ে আসছে। কিন্তু দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, আজকে চা শ্রমিকদের জিম্মি করে তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। চায়ের দেশ বাংলাদেশ। অথচ সেই দেশের চা শ্রমিকদের মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে। আগামী ২৩ আগস্ট চা শ্রমিকদের দাবির বিষয়ে একটি সভা রয়েছে। আমি আশা করব, ওই সভা থেকে সুষ্ঠু সমাধান আসবে।’
সমাবেশে অভিনেত্রী তানভীন সুইটি বলেন, ‘বিভিন্ন ফ্লেভারের চা খেয়ে আমরা আনন্দ-ফুর্তি করছি। কিন্তু আমরা সেই চা শ্রমিকদের নিয়ে ভাবি না। ফলে তাদের জীবনের কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না। দৈনিক ১২০ টাকা রোজগার করে কীভাবে জীবনযাপন করা যায়? দেশে সবকিছুর দাম বাড়ছে। আমাকে চিন্তা করতে হবে, আমি তো খাচ্ছি কিন্তু আমার বিপরীতে আরেকজন কী খাচ্ছে?’
তিনি বলেন, ‘চা শ্রমিকদের ৩০০ টাকা মজুরির দাবি যৌক্তিক। অবিলম্বে এ দাবি মেনে নেওয়ার আহ্বান জানাই।’
বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর (অব.) মফিজুল হক সরকার বলেন, ‘চা শ্রমিকদের দাবির সাথে আমি সংহতি প্রকাশ করছি। আমি মনে করি, চা শ্রমিকরা মাত্র ৩০০ টাকা মজুরির দাবি করেছে। এটা অযৌক্তিক দাবি নয় বরং যৌক্তিকের চেয়েও যৌক্তিক। কাজেই এ দাবি মেনে নেওয়ার জন্য আমি উদাত্ত আহ্বান জানাই।’
গৌরব ’৭১ এর সাধারণ সম্পাদক এফ এম শাহীন বলেন, ‘আমরা যারা সচেতন নাগরিক হিসেবে এই সমাজে বাস করি, তারা দেখতে পাচ্ছি যে, এ যুগে এসেও চা শ্রমিকদের মজুরি মাত্র ১২০ টাকা। এটা আমাদের জন্য লজ্জার, সমাজের জন্য লজ্জার।’
তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু বৈষম্যহীন ও অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় কাজ করে গেছেন। আজকে তারই কন্যা শেখ হাসিনার ক্ষমতায় থাকাকালে চা শ্রমিকরা মানবেতর জীবনযাপন করছে। এটা মানা যায় না। আমি রাষ্ট্রপক্ষের কাছে আহ্বান জানাই, দয়া করে শ্রমিকদের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের যৌক্তিক দাবি মেনে নিন।’
তিনি আরও বলেন, ‘চা শ্রমিকদের বঞ্চিত করতে সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনি এই সিন্ডিকেট ভেঙে দিন। মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের মানুষ এবং তরুণপ্রজন্ম আপনার সাথে আছে।’
গৌরব ’৭১ এর সহ-সভাপতি হাবিবুর রহমান রোমেল বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু স্বপ্ন দেখেছিলেন সমতার। অথচ আজকে আমরা কী দেখছি? চা শ্রমিকদের মজুরি মাত্র ১২০ টাকা। এটাকে যদি আমরা ঘণ্টায় ভাগ করি, তাহলে প্রতি ঘণ্টার মূল্য মাত্র ১৫ টাকা। এটা কি মানা যায়? অবিলম্বে চা শ্রমিকদের যৌক্তিক দাবি মেনে নেওয়া উচিত।’
লায়ন এ কে এম কেফায়েত উল্লাহ বলেন, ‘১৯৫৭ সালে চা বোর্ডের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি চা শ্রমিকদের জন্য কাজ করে গেছেন। আজকে সেই চা শ্রমিকদের আত্মাহুতি দিতে হচ্ছে, মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে। এটা মানা যায় না।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী অর্ক সাহা বলেন, ‘আমি মনে করি, চা শ্রমিকদের মজুরি ৩০০ টাকা বৃদ্ধি নয়, বরং এটা বাড়িয়ে ৫০০ টাকা করা উচিত।’
মাসুমা আক্তার পলি বলেন, ‘চা শ্রমিকদের এতোটা করুণ ইতিহাস আছে, সেটা আমাদের জানা ছিল না। এক্ষেত্রে আমি বলব, মিডিয়াগুলোও এ বিষয়ে তেমন কথা বলে না। আমি অনুরোধ করব, চা শ্রমিকদের কষ্টের কথাগুলো মিডিয়া প্রচার করুক।’
নাজনীন সুলতানা নাজু বলেন, ‘চা শ্রমিকদের মজুরি মাত্র ১২০ টাকা, এটা খুবই দুঃখজনক। গৌরব ’৭১ এটা নিয়ে সংহতি সমাবেশের ডাক দিয়েছে। তাই আমি ঘরে বসে থাকতে পারিনি।’
ঢাবি শিক্ষার্থী অপি করিম বলেন, ‘চা শ্রমিকদের মজুরি ৩০০ টাকা করার দাবি উঠেছে। এই দাবি তো ওঠার কথা না, বরং এই ন্যায্য দাবি সাথে সাথে মেনে নেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু তা মানা হলো না। আমি স্পষ্ট করে বলতে চাই, এদেশের প্রতিটি বৈষম্যের বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদ জানিয়েছে। এ যৌক্তিক দাবিও পূরণ না হলে আমরা আবার রাজপথে নামবো।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ইমরুল হাসান ইমন বলেন, ‘চা শ্রমিকদের মজুরি মাত্র ১২০ টাকা। এ যুগে এই টাকা দিয়ে পরিবার চালানো কোনোভাবে সম্ভব নয়। এটা আয়বৈষম্য। কাজেই অবিলম্বে চা শ্রমিকদের যৌক্তিক দাবি মেনে নেওয়া উচিত।’
তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থী কবির বলেন, ‘চা শ্রমিকদের মজুরি ৩০০ টাকা না হওয়া পর্যন্ত তাদের দাবির সাথে আমরাও আছি। প্রয়োজনে এ দাবির জন্য আমরা রাজপথে নামবো।’
গৌরব ’৭১ এর সভাপতি এস এম মনিরুল ইসলাম মনির সভাপতিত্বে এবং সাধারণ সম্পাদক এফ এম শাহীনের সঞ্চালনায় এতে আরো উপস্থিত ছিলেন বিবার্তা২৪ডটনেটের সম্পাদক বাণী ইয়াসমিন হাসি, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের বিশেষ সহকারী গুলশাহানা ঊর্মি, গৌরব ’৭১ এর সাংগঠনিক সম্পাদক রবিউল ইসলাম রূপম, লেখক ডাবলু লস্কারসহ প্রমুখ।
উল্লেখ্য, চা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ১২০ টাকা। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে এই মজুরি দিয়ে পরিবার নিয়ে চলা অসম্ভব। ফলে চা-শ্রমিকরা তাদের মজুরি বাড়ানোর দাবিতে আন্দোলন করছেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে তাদের দাবির সাথে সংহতি প্রকাশ করতে গৌরব ’৭১ এই সমাবেশের আয়োজন করেছে।
বিডি প্রতিদিন/জুনাইদ আহমেদ