উজানে সুইচগেইট নির্মাণে পানি প্রবাহ বন্ধ থাকায় পলি পড়ে ভরাট হয়ে মরছে করতোয়া নদী। গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার কাটাখালি নদীর খুলশি এলাকায় সুইচগেইট নির্মাণ করে পানি প্রবাহ বন্ধ হয়। পরে ধীরে ধীরে পলি পড়ে বগুড়ার দিকে প্রবাহিত করতোয়া নদী উঁচু হয়ে যায়। ফলে নদীর উৎসমুখে পানি প্রবেশ করতে পারছে না। প্রবাহ না থাকায় বর্তমানে করতোয়া নদী যৌবন হারিয়ে বিবর্ণ রূপ ধারণ করে প্রায় মৃত। অপরিচ্ছন্ন ও বড়সড় নর্দামার এই নদী এখন জীবাণু বহন করছে। মৃত প্রায় নদীকে বাঁচাতে ১৮শ ৪১ কোটি টাকার একটি প্রকল্প মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হয়েছে।
বগুড়ার ইতিহাসের পাতা থেকে জানা যায়, প্রায় ২০০ কিলোমিটার করতোয়া নদীর তীর ঘেঁষে প্রাচীন পুন্ড্রনগরীর গোড়া পত্তন হলেও সেই সভ্যতার সাথে এখন করতোয়া নদীও ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই নিতে চলেছে। করতোয়া নদী বগুড়া শহরের বুক চিরে প্রবাহিত হয়ে জেলার শেরপুর উপজেলার চান্দাইকোনায় বাঙালি নদীতে গিয়ে মিলেছে। উৎপত্তিস্থল থেকে এর দৈর্ঘ্য প্রায় ২০০ কিলোমিটার। এরমধ্যে দূষণ, দখল, ভরাট, পানি প্রবাহ না থাকায় মরা নদী হিসেবে পরিণত হয়েছে। এর আগে ১৯৮৮ সালে করতোয়া নদীতে ভয়াবহ বন্যা দেখা দেয়। ওই সময় বন্যায় বগুড়া শহরের বেশিরভাগ এলাকা তলিয়ে যায়। নদী ভাঙনও দেখা দেয়। বগুড়া শহরকে রক্ষা করতে নদীর পানি প্রবাহ নিয়ন্ত্রণে গাইবান্ধা জেলার নুরুল্লার বিল প্রকল্পের আওতায় গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার চকরহিমপুর নামক স্থানে (লোয়ার) করতোয়ার উৎসমুখে জলকপাট নির্মাণ করা হয়। এটি নির্মাণের মাধ্যমে করতোয়া নদীর গতিপথ পরিবর্তন করা হয়। সে সময় ওই অংশে করতোয়ার মূল স্রোত একটি শাখা নদীর মাধ্যমে বাঙালি নদীর সঙ্গে যুক্ত করা হয়। এতে গোবিন্দগঞ্জ থেকে বগুড়ার দিকে করতোয়া নদীর প্রবাহ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে দিনে দিনে সরু খালে পরিণত হয়। উজানে পানি শুন্যতায় প্রবাহ বন্ধ, অন্যদিকে ভরাট আর দখল এর ফলে নদীটি মৃত।
বগুড়া পৌরসভা সূত্রে জানা যায়, ২০০৪ সালে বগুড়া পৌরসভাকে মডেল টাউনে পরিণত করতে প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় প্রায় ৩শ কোটি টাকা। তৎকালীন সরকারের সময় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এই প্রকল্প গ্রহণ করেছিলেন।
বগুড়া পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্মকর্তারা বলছেন, করতোয়া নদীর যৌবন ফেরাতে বগুড়া অংশে পুনঃখনন ও স্লোপ প্রটেকশনের কাজ চলমান রয়েছে। প্রায় ৪৭ কোটি ১০ লাখ টাকা ব্যয়ে করতোয়া নদী পূর্ণখনন ও ডান তীরে স্লোপ প্রটেকশন কাজ প্রকল্পের মাধ্যমে ব্যস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড। এতে শহর অংশে ১৭ কিলোমিটার খনন, এসপি ব্রিজ থেকে জেলা প্রশাসক কার্যালয় পর্যন্ত ৭৩৫ মিটার নদীতীর রক্ষা কাজের মাধ্যমে জেলা প্রশাসক কার্যালয়সহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা রক্ষা পাবে। এছাড়া নতুন করে ৯ কোটি টাকা ব্যয়ে বগুড়ার মাটিডালি থেকে নওদাপাড়া পর্যন্ত ১১কিলোমিটার পুনঃখনন করা হচ্ছে।
বগুড়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ নাজমুল হক জানান, করতোয়া নদীর প্রাণ ফিরে পেতে পানি উন্নয়ন বোর্ড বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করেছে। প্রকল্পের আওতায় বগুড়া জেলার সদর উপজেলা ও শাজাহানপুর উপজেলায় করতোয়া নদীর ২৮ কিলোমিটার, সদর উপজেলাধীন সুবিল ও অটো খালের ২৭ কিলোমিটার খনন এবং করতোয়া নদীতীরে ৭৩৫ মিটার স্লোপ প্রটেকশন ও ওয়াকওয়ে নির্মাণ করা হচ্ছে। বর্তমানে করতোয়া নদী উন্নয়ন প্রকল্প এর আওতায় প্রকল্পটির কাজ এগিয়ে চলেছে। এখন উজানে ৫৭ কিলোমিটার ও ভাটিতে ২৩ কিলোমিটার খনন কাজ বাকি রয়েছে। মোট ৮০ কিলোমিটার পুনঃখনন করা হলে করতোয়া তার অস্তিত্ব ফিরে পাবে। সারা বছর পানি প্রবাহ থাকবে। পুনঃখনন কাজ শেষ হলে নদীটি প্রাণ ফিরে পাবে। এছাড়া মৃত করতোয়া নদীকে বাঁচাতে নতুন করে ১৮শ ৪১ কোটি টাকার একটি প্রকল্প মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হয়েছে।
প্রকৃতি ও পরিবেশ সংরক্ষণ সংস্থা গাইবান্ধা জেলা শাখার সভাপতি আহম্মেদ উল্লাহ জানান, করতোয়ার উৎপত্তি গাইবান্ধার কাটাখালি নদীর খুলশি এলাকায় বাঁধ নির্মাণ করায় উজান থেকে পানি প্রবাহ কমে যায়। এক পর্যায়ে পলি পড়ে কাটাখালি নদী থেকে করতোয়া নদী বেড লেভেল ৮ থেকে ১০ ফুট উঁচু হয়। এসব কারণে ইতিহাস থেকে হারিয়ে যায় নদীটির যৌবন। আমরা সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি নদীটি পুনঃখনন করে কাটাখালি অংশে দুটি সুইচগেইট (জলকপাট) নির্মাণ করার। সুইচগেইট (জলকপাট) নির্মাণ করলে বর্ষাকালে কাটাখালি নদীর পানি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। আর শুস্ক মৌসুমে সুইচগেইটটি খুলে দিলে করতোয়া নদীর পানি দিয়ে কৃষকরা তাদের জমিতে চাষাবাদ করতে পারবেন। একই সাথে সারাবছর নদীতে পানি প্রবাহ থাকবে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) বগুড়া জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক জিয়াউর রহমান জিয়া জানান, ১৯৮৮ সালে বন্যার সময় গাইবান্ধা জেলা ও বগুড়া জেলার বিভিন্ন অংশ পানিতে ডুবে যায়। সেইসময় তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হুসাইন মুহাম্মাদ এরশাদকে করতোয়া নদীর মুখে বাঁধ নির্মাণ করার দাবি জানানো হয়। পরে সেখানে একটি বাঁধ নির্মাণ করা হয়। এরপর থেকেই মরতে থাকে করতোয়া। নদীতে বর্ষা মৌসুম বা বন্যার সময় ছাড়া পানি দেখা যায় না। নদীটির উজানে খনন করে কাটাখালি অংশে দুটি সুইচগেইট (জলকপাট) নির্মাণ করতে হবে। যা বর্ষা মৌসুম বা বন্যার সময় বন্ধ রাখতে হবে। আর শুস্ক মৌসুমে খুলে দিলে করতোয়ার যৌবন ফিরে আসবে।