শুক্রবার, ২৮ জানুয়ারি, ২০২২ ০০:০০ টা

জয়শ্রীর জয়ধ্বনি

রণজিৎ সরকার

জয়শ্রীর জয়ধ্বনি

গ্রামের অনেক বাড়িতে আগুন জ¦লছে। জীবন বাঁচাতে ঘরবাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছে অনেক মানুষ। সবাই খুব দ্রুত গতিতে হেঁটে যাচ্ছে। কখনো জমির আইল, কখনো কাদামাটি, কখনো জঙ্গলের ভেতর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে ওরা। পাকিস্তানি আর্মি ও রাজাকারদের চোখে পড়লে বিপদ হতে পারে, মৃত্যু হতে পারে। তাই লুকিয়ে লুকিয়ে যাচ্ছে ওরা। জয়শ্রী তার মায়ের ডান কোলে বসা। মায়ের বাঁ হাতে কাপড়ের ব্যাগ। কিছু দূর যাওয়ার পর জয়শ্রী দেখতে পেল তার মায়ের ডান পা দিয়ে রক্ত ঝড়ে পড়ছে। জয়শ্রী বলল, ‘মা, তোমার পা দিয়ে রক্ত ঝড়ছে। তুমি থাম।’

মা পায়ের দিকে না তাকিয়ে বললেন, ‘বিলের ধারে কাদামাটি ও জঙ্গলের ভেতর দিয়ে এসেছি তো। মনে হয় জোঁক ধরেছে। জোঁক রক্ত খাচ্ছে খাক। দেশ স্বাধীন করার জন্য কত মানুষ জীবন উৎসর্গ করেছেন। যুদ্ধ করছেন। আমার পায়ের রক্ত নিয়ে চিন্তা করো না।’

মায়ের পায়ের দিকে তাকিয়ে জয়শ্রী বলল, ‘মা তুমি থামো। তোমার পায়ের দিকে তাকাও। জোঁক তো দেখছি না। তোমার পায়ে কিছু একটা ঢুকেছে।’

‘চুপথাক। তোমার কাকা কাকিরা অনেক দূরে চলে গেছে। একটু জোরে হাঁটি। ওদের কাছাকাছি তো যেতে হবে।’

জয়শ্রীর বাবা যুদ্ধে গেছেন। বাবা যুদ্ধে না গেলে হয়তো এখন পাশেই থাকতেন। এক সঙ্গে হেঁটে যেতেন। জয়শ্রী একবার হয় তো বাবার কোলে থাকত আবার মায়ের কোলে থাকত। এখন মায়ের কোলে বসে হেঁটে যাচ্ছে। মায়ের কষ্ট হচ্ছে। তবুও হেঁটে যাচ্ছেন। মা কিছুতেই জয়শ্রীর কথা শুনছেন না। মা হেঁটে যাচ্ছেন। জয়শ্রী যখন বুঝতে পারল মা তার কথা শুনে থামবে না। আর থামলে হয় তো বিপদে পড়তে পারেন, তাই তিনি হেঁটে যাচ্ছেন। জয়শ্রী মায়ের কষ্ট অনুভব করে বুদ্ধি বের করল। কিছুদূর অনুভব হওয়ার পর একটা বাড়ির পাশে টিউবওয়েল দেখে বলল, ‘মা আমার খুব পিপাসা লেগেছে। একটু জল খেতে হবে।’

এবার আর সন্তানের কথা ফেলতে পারলেন না। টিউবওয়েলের কাছে গিয়ে জয়শ্রীকে

কোলে থেকে নামিয়ে দিলেন। তখন জয়শ্রী বলল, ‘মা এবার তোমার পায়ের দিকে দেখ।’

এবার মা নিজের পায়ের দিকে তাকালেন। দেখতে পেলেন তার পায়ের ভেতর একটা খেজুর গাছের কাটা ঢুকে আছে। পায়ের নিচে দিয়ে ঢুকে উপর দিয়ে বেরিয়ে গেছে। দেখার সঙ্গে সঙ্গে জয় বাংলা বলে তিনি এক টান দিয়ে খেজুরের কাটাটা বের করলেন। ব্যাগের ভেতর থেকে একটা কাপড় বের করে মায়ের পায়ে বেঁধে দিল জয়শ্রী।

তারপর জয়শ্রী বলল, ‘মা আমাকে কোলে নিয়ে হাঁটলে তোমার কষ্ট হবে। আমি তোমার সঙ্গে হেঁটে যাই।’

‘তুমি জোরে হাঁটতে পারবে না। ধীরে হাঁটলে বিপদ হতে পারে। তুমি আমার কোলে উঠ।’

পাঁচ বছরের জয়শ্রী আবার মায়ের কোলে উঠল।

মা হেঁটে যেতে লাগলেন। জনবিচ্ছিন্ন ভবানীপুর গ্রামে গিয়ে আশ্রয় নিলেন ওরা। যুদ্ধ চলছে। জয়শ্রী তার বাবার জন্য প্রার্থনা করছে। তিনি যেন জীবিত থাকেন। যুদ্ধে শেষে বাবার সঙ্গে দেখা হয়। এটাই তার এক মাত্র প্রার্থনা। ১৬ ডিসেম্বরে বিজয় ঘোষণা করা হল। আশ্রয় নেওয়া সবাই রেডিওর মাধ্যমে খবর জানতে পারল। খুশিতে মা বললেন, ‘জয়শ্রী, তুমি জয়ধ্বনি কর।’

দেশ স্বাধীন হয়েছে শুনে জয়শ্রী জয়ধ্বনি করতে লাগল। জয়ধ্বনি করতে করতে গ্রামের বাড়িতে এলো সবাই। জয়শ্রী বাড়িতে এসে দেখে যুদ্ধ শেষ করে বাবা এসে হাজির। জয়শ্রীকে দেখা মাত্র বিজয়ের আনন্দে বাবা তাকে দুই হাত দিয়ে উঁচু করে ধরে লাল সবুজের পতাকার মতো করে ঘুরে ঘুরে উড়াতে লাগল।

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর