১৪ ডিসেম্বর, ২০১৯ ২১:৩৫

এই ঘটনা একজন আফিফার

দেবী গাফফার

এই ঘটনা একজন আফিফার

দেবী গাফফার

আমি কাল্পনিক নই, আমার কল্পনা শক্তি নেই। জীবন চলার পথে আশেপাশে যা দেখি তাই আপনাদের সমীপে পেশ করি। এই গল্প আফিফার মুখে যেদিন শুনেছিলাম সারারাত ঘুমাতে পারিনি। এই ঘটনা আফিফার। একজন ধর্ষিতার।

"দেবী", "আমি আফিফা"। আমার নামের অর্থ পুণ্যবতী। আমার বয়স যখন ছয়-সাত, স্টেশন থেকে দূরে একটু বেশি দূরে টেকনাফের কোনো গ্রামে আমাদের বাসা, পাহাড়ের চূড়ায় এক টুকরো ছনের ঘর। উল্টো দিকে বিশাল সমুদ্র, কূল-কিনারা নেই। আশেপাশে কোনো ঘর বাড়িও নেই। সকাল হলে জনাকয়েক জেলে কাঁধে মাছের ঝুঁড়ি নিয়ে বাজারের দিকে যেতে দেখা ছাড়া আর কোনো জনমানব চোখে পড়তো না। সন্ধ্যা হতে না হতেই নেমে আসতো ভুতুড়ে অন্ধকার। ক্ষুধার্ত শিয়ালের গগনবিদারি ডাক।

আমার বাবা একজন ঘড়ির মেকানিক। বাজারে ছোট্ট একটা টেবিলে ঘড়ির বিভিন্ন পার্টস সাজিয়ে বসেন। আমরা চার বোন। ছোট্ট রুমের ঘরে মা-বাবাসহ গাদাগাদি করে থাকি।

জেলেরা রাতভর মাছ ধরে সমুদ্র পাড়ে নৌকা ভিড়াতো, কোনো কোনো দিন নৌকার পাশে গিয়ে দাঁড়ালে জেলেরা বলতো : 'নে মাছ আলাদা কর, খাওয়ার মাছ পাবি'।

চিংড়ি লইট্যা আলাদা করতে করতে হাত জ্বলতো, মাছ নিয়ে ঘরে আসলে, মার চোখেমুখে খুশীর আভার ছটা দেখা যেতো। রাত ৮টা-৯টার আগে বাবা আসেন না। আমরা বোনরা রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকি, যতদূর চোখ যায়। দূরে হালকা কোনো টর্চের আলোর মতো মনে হলেই আমরা বাবা বাবা বলে চিৎকার জুড়ে দিতাম। 

বাবা আসেন, হাতে বাজারের ব্যাগ। আমরা অপলকে তাকিয়ে থাকতাম, এক কেজি চাল, অল্প ছোট মাছ ছাড়া কিছুই থাকতো না। আমরা আশা করতাম, মুড়ির মোয়া বা এক ঠোংগা বাদাম।

না কিছুই থাকতো না। রাত বাড়তো, মাছের ঝোল আর ভাতের অপেক্ষায় থাকতে থাকতে কখন ঘুমিয়ে পড়তাম কে জানে। বাবা ঘুম থেকে উঠিয়ে মুখে তুলে খাইয়ে দিতেন।

এক কেজি আতপ চালের ভাত, ছয়জন মানুষের ক্ষিদে নিবারণ হয় না। মা কোনো দিন প্লেটে ভাত নিয়ে খেতেন না, হাড়িতেই খেতেন, পাছে বাবা বুঝে ফেলেন মার ভাগে একমুঠো ভাতের বেশি অবশিষ্ট নেই। আমরা ওই এক বেলাই পেট ভরে খেতাম। দিনের বেলা ভাত জুটতো না।
কোনো এক রাতে বাবা-মার কথা কানে আসে;   

বাবা: 'চলো কক্সবাজার চলে যাই। এভাবে আর কতোদিন চলবে, বাচ্চাগুলো না খেতে পেয়ে মারা যাবে।'
মার উত্তর শোনা হয়নি, ঘুমিয়ে পড়ি।

কয়েকদিন পরেই আমরা কক্সবাজার চলে যাই। কক্সবাজার পৌঁছে এক খালার বাসায় উঠি, খালার অবস্থা ও তথৈবচ। ছোট্ট দুটি কক্ষে ছয় বাচ্চা নিয়ে কোনোমতে থাকা। বিধবা খালা।

কক্সবাজার এয়ারপোর্ট এলাকায় বাসা নেওয়া হলো। এক রুমের বাসা, ভাড়াও কম। বাবা ঘড়ির মেকানিকের কাজ করতে থাকে, আমরা দুই বেলা পেট ভরে খেতে পাই। সুখে-দুঃখে সময় বয়ে চলে।

আমার যখন ১০ বছর, বাবা-মার নিষেধাজ্ঞা জারি হলো, 'রুম থেকে বের হওয়া যাবে না'। খেলাধুলা বন্ধ, সারাদিন রুমে বসে থাকা। বের হলেই বুঝতে পারতাম ছেলে-বুড়ো হা করে আমাকে দেখতো। গরীবের ঘরে জন্ম নেওয়া আমার রূপই আমার আজন্ম পাপ হয়ে গেলো। চারিদিক থেকে বিয়ের প্রস্তাব আসে, পঞ্চাশোর্ধ্ব পাত্রদের। রাত বাড়ার সাথে সাথে ঘরের চারিদিকে বখাটেদের হাটাচলা শুরু হয়। মা-বাবা ভয়ে ঘুমাতে পারে না। বেরার ঘর কি এমন দরজা। যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটে? কি হচ্ছে আমার কি অপরাধ কিছুই বুঝি না। আমি বুঝি আমার ক্ষিদে লাগে, নির্লজ্জ ক্ষিদে থমার নামই নেয় না। মনে মনে ভাবি, একটা যদি ভাতের পাহাড় হতো? মা-বাবা, বোনদের নিয়ে চিরতরে ওই পাহাড়ে চলে যেতাম।

বখাটেদের উৎপাত বেড়েই চলে। এক সকালে মা বললেন- চলো খালার বাসায় যাবো। দূর সম্পর্কে খালা, সচ্চল পরিবার। খালার দুই ছেলে, চার মেয়ে, নাতি-নাতনিদের নিয়ে যৌথ পরিবার। সবার বড় ভাইয়ার দুই বউ। দুই বউয়ের পাঁচ-সাতটা বাচ্চা। 

মা খালার পাশে বসে কেঁদে কেঁদে বললেন- আমাকে বাসায় রাখার নিরাপত্তা নিয়ে। খালা আমাকে আশ্রয় দিলেন। আমাকে খালার বাসায় রেখে মা আমার চোখে মুখে হাত বুলিয়ে জড়িয়ে ধরে বললেন, এখানে থাকো নিরাপত্তা পাবে তদুপরি পেট ভরে খেতেও পাবে। মা চোখ মুছতে মুছতে বের হয়ে গেলেন।

এই প্রথম সবাইকে ছেড়ে একা কোথাও থাকা। কেমন একটা হাহাকার আমার ভিতরে আছড়ে পড়তে থাকে। বড় ভাই বড় ভাবীর ঘরেই ঘুমান। ছোট ভাবী ঘরের এক কোনায় কোলের বাচ্চাটা নিয়ে থাকেন। আমার থাকার জায়গা হলো ছোট ভাবীর রুমে। ছোট ভাবীকে মার মতো লাগতো। ওই বাসায় যদি কেউ আমাকে আদর করে থাকে সে ওই ছোট ভাবী।

রাতের খাওয়া শেষ করে আমি আর ছোট ভাবী গল্প করি, একটু পরে ভাইয়াও আমাদের সাথে গল্পে যোগ দেন। এক ফাকে ভাবী বলে পান খাবি? আমি মাথা হেলিয়ে বলি খাবো। সাথে সাথে ভাইয়া উঠে পান আনতে গেলেন। পান খেতে খেতে কখন ঘুমিয়ে পড়ি বুঝতে পারি না। হালকা মনে পড়ছে, ভাই-ভাবীর হাসি ইঙ্গিতপূর্ণ আধা আধা কথা।

সকালে ঘুম ভাঙলো, আমার সারা শরীর এত ব্যথা কেনো? আমি উঠতে পারি না, পেটের নিচের অংশে ব্যথায় চোখে পানি চলে আসে। বিছানায় ছোপ ছোপ রক্ত। পরনের পায়জামা পায়ের কাছে পড়ে আছে।

বুঝতে পারি ভাইয়া-ভাবী পানের সাথে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে আমার সর্বনাশ করেছে। কুকুর রূপের নোংরা লোকটা আমার শরীর ক্ষত-বিক্ষত করেছে। দুই সতীনের সংসারে স্বামী বশ করার তাবিজ হিসেবে আমাকেই বলি চড়ালো। আমি ভাবতে থাকি কি হলো? কেনো হলো? মা তো বলতেন, বিয়ের আগে কাউকে শরীরের এখানে-ওখানে ধরতে দিওনা। আমি তো ধরতে দিইনি। ১০ বছরের আমি কি করবো, কাকে বলবো।
একা একা কোঁকাতে থাকি।

ছোট ভাবীকে বলি- আমি উঠে দাঁড়াতে পারছি না। ভাবী মুচকি মুচকি হেসে বলে- ঠিক হয়ে যাবে।

আমি বাকশূন্য, পৃথিবীর রূপ এমন কেনো? সেদিন প্রথম কোনো মহিলার এমন কুৎসিত হাসি দেখি। এ যেন ছোটবেলায় শোনা রূপকথার ডাইনি। বিকেলে মা আসে।

চলবে...

(ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)

বিডি প্রতিদিন/এনায়েত করিম

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর