প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ বলেছেন, এ মুহূর্তে আমরা এক ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে আছি। বিগত বছরগুলোতে বিচার প্রক্রিয়ায় আমাদের বিচারবোধ, ন্যায়বিচারের মূল্যবোধকে বিনষ্ট ও বিকৃত করা হয়েছে। গতকাল আপিল বিভাগের ১ নম্বর এজলাসে অনুষ্ঠিত সংবর্ধনায় এসব কথা বলেন প্রধান বিচারপতি। সংবর্ধনায় প্রথমে অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান ও পরে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির (সুপ্রিম কোর্ট বার) সভাপতি ব্যারিস্টার এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন বক্তব্য দেন। এ সময় সুপ্রিম কোর্টের সব বিচারপতি, জ্যেষ্ঠ আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট বারের সভাপতিসহ আইনজীবীরা উপস্থিত ছিলেন। বক্তব্যের শুরুতে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ বলেন, ‘আমি কৃতজ্ঞতা ও গভীর শ্রদ্ধা জানাই গণজাগরণে আত্মদানকারী প্রত্যেক শহীদের স্মৃতির প্রতি। আমি তাদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। ছাত্র-জনতার এ অভ্যুত্থানের সময় অসংখ্য শিক্ষার্থী, সাধারণ মানুষ আহত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তাদের অনেকে এখনো চিকিৎসা নিচ্ছেন। আমি তাদের সবার দ্রুত নিরাময় ও সুস্থতা কামনা করছি। প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আমি সারা দেশের সব ছাত্র-জনতাকে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতির পক্ষ থেকে অভিনন্দন জানাচ্ছি। আমি আরও অভিনন্দন জানাই বাংলাদেশের সর্বস্তরের জনগণকে, যারা শিক্ষার্থীদের এ আন্দোলনে পূর্ণ সমর্থন দিয়েছেন।’ অনুষ্ঠানে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ বলেন, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও এর ফলে সংঘটিত গণ অভ্যুত্থানের কারণ আপনারা সবাই অবগত। এ মুহূর্তে আমরা এক ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে আছি। বিগত বছরগুলোতে বিচার প্রক্রিয়ায় আমাদের বিচারবোধ, ন্যায়বিচারের মূল্যবোধকে বিনষ্ট ও বিকৃত করা হয়েছে। সততার বদলে শঠতা, অধিকারের বদলে বঞ্চনা, বিচারের বদলে নিপীড়ন, আশ্রয়ের বদলে নির্যাতনকে স্বাভাবিক ব্যাপারে পরিণত করা হয়েছে। অথচ এরকম সমাজ ও রাষ্ট্র আমরা চাইনি। এখন আমাদের নতুন যাত্রা শুরু করতে হবে।’ প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ বলেন, ‘আজ থেকে প্রতিটি শ্রেয়, শুভ ও কল্যাণকর কর্মে সবাই বিচার বিভাগকে আপনাদের পাশে পাবেন। আমি সচেতন আছি, আমাকে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, সুপ্রিম কোর্ট ছাড়াও জেলা জুডিশিয়ারি হলো বিচার বিভাগের সবচেয়ে বড় ও বিস্তৃত ক্ষেত্র। অধস্তন জুডিশিয়ারিতে কর্মরত বিচারক সহকর্মীরা আমাদের সবচেয়ে বড় শক্তি। দেশের সাধারণ মানুষ বিচার বিভাগ বলতে মূলত ডিস্ট্রিক্ট জুডিশিয়ারিকে বোঝেন।’ প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘শিষ্টের লালন ও অন্যায়ের দমন হলো বিচার বিভাগের শাশ^ত দায়িত্ব। বিচারক ও কর্মকর্তাদের মধ্যে যে কেউ অন্যায় বা শিষ্টাচার লঙ্ঘন করলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যে কেউ ভালো কাজ করলে তাকে পুরস্কৃত করা হবে। কিন্তু কোনো ধরনের বিচ্যুতিকে প্রশ্রয় দেওয়া হবে না।’
গুম-খুনের শিকার আত্মা ন্যায়বিচারের প্রতীক্ষায়- অ্যাটর্নি জেনারেল : সংবর্ধনায় প্রধান বিচারপতিকে উদ্দেশ করে অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেন, খুন-গুম-নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার সব আত্মা ন্যায়বিচারের প্রতীক্ষায় প্রধান বিচারপতির দিকে তাকিয়ে আছে। গোটা দেশবাসীর মতো আমিও আশা করি আপনি তাদের বিমুখ করবেন না। তিনি বলেন, দ্বিতীয় মুক্তিসংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জিত এক স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রথম প্রধান বিচারপতি আপনি। আপনাকে রাষ্ট্রপতিই শুধু পছন্দ করে নিয়োগ দেননি, আপনার নিয়োগের পেছনে রয়েছে এ দেশের শত শত ছাত্রের বুকের তাজা রক্তে ভেজা রাজপথের কালজয়ী অমর কাব্যের এক বীরত্বগাঁথা উপাখ্যান। পৃথিবীর ইতিহাসে এ ঘটনা বিরল।
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, বিগত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া অনেকগুলো গুম হওয়া মানুষের আত্মা, অসংখ্য মানুষের বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের শিকার হওয়ার বেদনা, অগণিত মানুষের নির্যাতন-নিপীড়নের গল্প, অনেক মৃত মানুষের মামলায় আসামি হওয়ার অভিশাপ, অনেক পরিবারের নিঃস্ব হওয়ার হাহাকার থেকে উৎসারিত প্রতিবাদের ভাষা থেকে প্রতিরোধে রূপ নেওয়ার অন্য অবয়ব আজকের বাংলাদেশ। এ দেশকে, এ দেশের সংবিধানকে, এ দেশের মানুষের অধিকার রক্ষার্থে, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সংবিধানের অভিভাবক হিসেবে আপনার নেতৃত্বে সুপ্রিম কোর্টের অভিভাবকত্ব প্রকাশ পাক এটা আবু সাঈদ-মুগ্ধ-ফারাজসহ শত শহীদের প্রত্যাশা ছিল, তাদের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের অন্তর্নিহিত কারণ ছিল। তিনি বলেন, দেশ আজ গণতন্ত্রহীন, মানুষ অধিকারহীন, গণমাধ্যমের কণ্ঠ রুদ্ধ। ওইসব মরণঘাতী বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতির কারণে এ অঙ্গনে মেধাবী আইনজীবীরা অনেকে শুরুতেই ঝরে যায়, ফুটে ওঠে দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতির কিছু বিবেকহীন আইনজীবী, যার ফলে ভালো আইনজীবী তৈরি হচ্ছে না।
প্রভাবমুক্ত স্বাধীন বিচার বিভাগ নিশ্চিতের আহ্বান বার সভাপতির : প্রভাবমুক্ত সম্পূর্ণ স্বাধীন বিচার বিভাগ নিশ্চিত করতে প্রধান বিচারপতির কাছে আহ্বান জানিয়েছেন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ব্যারিস্টার এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন। তিনি বলেন, বিগত দিনে বিচার বিভাগকে ক্রমান্বয়ে দলীয়করণ ও রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করে নির্বাহী বিভাগের আজ্ঞাবহ করে রাখার মাধ্যমে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। তিনি বলেন, ‘আমরা দেখেছি কীভাবে দেশে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে ছাত্র-জনতার যৌক্তিক ও অরাজনৈতিক শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে বিচার বিভাগকে জনরোষের মধ্যে ফেলে কলঙ্কিত করার চেষ্টা করা হয়েছে। আমরা আর এ ধরনের ন্যক্কারজনক অধ্যায়ের পুনরাবৃত্তি আশা করি না।’ ব্যারিস্টার খোকন বলেন, শত শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এই নতুন স্বাধীনতা রক্ষায় এবং আগামীর বাংলাদেশ বিনির্মাণের লক্ষ্যে বিচার বিভাগের প্রতি নতুন প্রজন্ম এবং বাংলাদেশের গণমানুষের যে আশা-আকাক্সক্ষা তার প্রতিফলন ঘটানো অত্যাবশ্যক। আপনি বিচার বিভাগের প্রভাবমুক্ত সম্পূর্ণ স্বাধীন বিচার বিভাগ নিশ্চিত করবেন। নাগরিকের সাংবিধানিক ও মৌলিক অধিকার রক্ষার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবেন। মামলা পরিচালনার দীর্ঘসূত্রতা দূর করবেন এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করবেন। ছাত্রদের আন্দোলনের মুখে গত শনিবার প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান পদত্যাগ করেন। তারপর আপিল বিভাগের পাঁচ বিচারপতি পদত্যাগ করেন। এরপর হাই কোর্ট বিভাগের বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদকে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। এরপর রবিবার শপথ গ্রহণের পর গতকাল প্রথমবারের মতো প্রধান বিচারপতি হিসেবে এজলাসে বসেন বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ।