প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন (ইসি) গতকাল দুপুর ১২টায় পদত্যাগ করেছে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করা এ কমিশন মেয়াদ শেষ হওয়ার আড়াই বছর বাকি থাকতেই সাংবিধানিক পদ থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দিল। নির্বাচন কমিশনের পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। গতকাল বঙ্গভবনের প্রেস উইং এ তথ্য জানিয়েছে। উইং বলেছে, প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ সব কমিশনারের পদত্যাগপত্র রাষ্ট্রপতি কর্তৃক গৃহীত হয়েছে। পদত্যাগ ঘোষণার আগে বিদায়ী ব্রিফিংয়ে ভবিষ্যতের প্রতিটি সাধারণ নির্বাচন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন অনুষ্ঠানের পরামর্শ দিয়েছেন কাজী হাবিবুল আউয়াল। তিনি বলেন, বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর সমরূপতার কারণে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক (দলীয়-ভিত্তিক) নির্বাচনের জন্য বাংলাদেশ আদর্শ ক্ষেত্র হতে পারে। সেই সঙ্গে নির্বাচন চার বা আট পর্বে, প্রতিটি পর্বের মাঝে তিন থেকে পাঁচ দিনের বিরতি রেখে অনুষ্ঠান করা ব্যবস্থাপনার দিক থেকে সহজ ও সহায়ক হতে পারে। গতকাল দুপুরে আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে সংবাদ সম্মেলনে বিদায়ী সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, ‘আমিসহ মাননীয় কমিশনারগণ দেশের পরিবর্তিত বিরাজিত অবস্থায় পদত্যাগ করতে মনস্থির করেছি। আমরা অদ্যই পদত্যাগপত্র মহামান্য রাষ্ট্রপতির সমীপে উপস্থাপনের নিমিত্ত কমিশনের সচিব মহোদয়ের কাছে দেব।’ এরপর ব্রিফিং শেষ করেই পদত্যাপপত্রে স্বাক্ষর করে সচিবের হাতে তুলে দেন সিইসি। এ সময় সিইসির সঙ্গে ছিলেন দুই নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. আহসান হাবিব খান ও সাবেক সিনিয়র সচিব মো. আলমগীর। নির্বাচন কমিশনার রাশিদা সুলতানা ও আনিছুর রহমান অনুপস্থিত ছিলেন। পদত্যাগ করে বন্ধুর গাড়িতে ইসি ছাড়েন কাজী হাবিবুল আউয়াল। গতকাল তিনি নিরাপত্তা সুবিধা নিলেও সরকারি গাড়িসুবিধা নেননি। বন্ধুর পুরনো মডেলের সাদা রঙের একটি গাড়িতেই নির্বাচন ভবন থেকে বাসার দিকে যান। এরপর নিরাপত্তা সুবিধা নিয়ে ইসি ছাড়েন আরও তিন নির্বাচন কমিশনার। এ সময় তাঁদের গাড়ির দিকে জুতা নিক্ষেপ করে বিক্ষুব্ধ জনতা। অন্যদিকে ইসি আহসান হাবিব খান ইটিআই, এনআইডি উইং, আঞ্চলিক নির্বাচন অফিসসহ নির্বাচন কমিশনের বিভিন্ন দপ্তরে গিয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে বিদায়ী সৌজন্য সাক্ষাৎ করে বিকাল ৫টার দিকে নির্বাচন ভবন ত্যাগ করেন।
২০২২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি দেশের ত্রয়োদশ সিইসি হিসেবে দায়িত্ব নেন হাবিবুল আউয়াল। তাঁর নেতৃত্বে এ কমিশনের পরিচালনায় এ বছর ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন হয়। এ ছাড়া এ আড়াই বছরে দেড় সহস্রাধিক বিভিন্ন নির্বাচন করেছে কমিশন।
হাবিবুল আউয়ালের ব্রিফিংয়ে পড়া লিখিত ভাষণের শব্দসংখ্যা ছিল ৭ শতাধিক। লিখিত ভাষণের শেষে ‘নিজের অভিজ্ঞতার নিরিখে’ তিনি কিছু প্রস্তাব দেন। হাবিবুল আউয়াল বলেন, ‘বর্তমান ও অতীত থেকে আহৃত অভিজ্ঞতা, জ্ঞান ও উপলব্ধি থেকে ভবিষ্যতের জন্য কিছু প্রস্তাব সরকারের সদয় বিবেচনার জন্য রেখে যাওয়া কর্তব্য মনে করছি। বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর সমরূপতার কারণে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক (দলীয়-ভিত্তিক) নির্বাচনের জন্য বাংলাদেশ আদর্শ ক্ষেত্র হতে পারে। সেই সঙ্গে নির্বাচন চার বা আট পর্বে, প্রতিটি পর্বের মাঝে তিন থেকে পাঁচ দিনের বিরতি রেখে অনুষ্ঠান করা ব্যবস্থাপনার দিক থেকে সহজ ও সহায়ক হতে পারে। আমাদের প্রবর্তিত অনলাইনে নমিনেশন দাখিল অব্যাহত রেখে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় প্রযুক্তির ব্যবহার অপটিমাইজ করতে পারলে উত্তম হবে। প্রতিটি সাধারণ নির্বাচন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত হলে উদ্দেশ্য অর্জন আরও সুনিশ্চিত হতে পারে।’
সিইসির বিদায়ী বক্তব্য : সংবাদ সম্মেলনে পদত্যাগের ঘোষণা দেওয়ার আগে কাজী হাবিবুল আউয়াল বাংলাদেশের বিগত নির্বাচনগুলোর ইতিহাস তুলে ধরেন। তিনি বলেন, দেশের প্রথম সাংবিধানিক সাধারণ নির্বাচন ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সে নির্বাচন নিয়েও বিতর্ক ছিল। ১৯৭৯ ও ১৯৮৮ সালের সাধারণ নির্বাচন সামরিক শাসনামলে হয়েছে। ফলাফল নিয়ে বিতর্ক ছিল। ১৯৯১-এর নির্বাচন সম্মত রাজনৈতিক রূপরেখার ভিত্তিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হয়েছিল। ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের নির্বাচন সাংবিধানিক নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সূক্ষ্ম বা স্থূল কারচুপির সীমিত সমালোচনা সত্ত্বেও সার্বিকভাবে গ্রহণযোগ্য হয়েছিল।
তিনি বলেন, ২০০৮ সালের নির্বাচন সেনাসমর্থিত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়েছে। সে নির্বাচনে বিএনপি সংসদে মাত্র ২৭টি এবং আওয়ামী লীগ ২৩০টি আসন পেয়েছিল। নির্বাচন বিতর্কের ঊর্ধ্বে ছিল না। নিরাপদ প্রস্থান বিষয়ে বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের সঙ্গে সেনাসমর্থিত অসামরিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দরকষাকষির বিষয়টি প্রকাশ্য ছিল। সে প্রশ্নে বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের অবস্থানও গোপন ছিল না। ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের নির্বাচন সংবিধানমতে দলীয় সরকারের অধীনে হয়েছে।
আগেও পুরো কমিশন বিদায় : বাংলাদেশে মেয়াদপূর্তির আগে পুরো কমিশনের বিদায় নেওয়ার ঘটনা এটাই প্রথম নয়। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি জরুরি অবস্থা জারির পর ফখরুদ্দীন আহমদ নেতৃত্বাধীন সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার এলে বিদায় নিতে হয়েছিল বিচারপতি এম এ আজিজের নেতৃত্বাধীন তৎকালীন নির্বাচন কমিশনকে। সিইসির দায়িত্বে বিচারপতিদের মধে?্য মো. ইদ্রিস ও এ টি এম মাসউদ এবং সাবেক আমলাদের মধ্যে এম এ সাঈদ, শামসুল হুদা, কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ ও নূরুল হুদা পাঁচ বছর মেয়াদ পূর্ণ করতে পেরেছিলেন।
বাংলাদেশে নির্বাচন কমিশন গঠনে দীর্ঘদিন কোনো আইন ছিল না। ২০২২ সালে নতুন কমিশন গঠনের আগে আকস্মিকভাবেই আইন প্রণয়ন হয়। আর সে আইনের অধীনে প্রথম নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব নেন কাজী হাবিবুল আউয়ালসহ পাঁচজন।
শূন্য ইসি : সবশেষ মেয়াদপূর্ণ করে নূরুল হুদা কমিশন ২০২২ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি বিদায় নেয়। ২০২২ সালে কে এম নূরুল হুদা নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের নির্বাচন কমিশন পাঁচ বছর মেয়াদ পূর্ণ করার পর অন্তত ১২ দিন শূন্য ছিল নির্বাচন কমিশন। এর আগে ২০০৭ সালে বিচারপতি এম এ আজিজ কমিশনের পদত্যাগের পরও শূন্য ছিল। তৎকালীন আইনমন্ত্রী তখন বলেছিলেন বলেন, সংবিধানে, আইনে এ রকম শূন্যতার কথা, শূন্য থাকতে পারবে না-এমন কথা নেই। নতুনরা না আসা পর্যন্ত নির্বাচন কমিশন বন্ধ হয়ে যাবে, এমন নয়। প্রশাসনিক দায়িত্বটা পালন করবে ইসি সচিবালয়। নতুন ইসি এলেই নির্বাচনের ব্যাপারে পদক্ষেপ নেবে।