উত্তাল সত্তরের দশক। নদীয়ার শান্তিপুর থেকে দাদার হাত ধরে একটি ছেলে ট্রেনে করে কলকাতা আসছে রোজই। বিভিন্ন বাড়ির সদর দরজায় দরজায় শাড়ি বিক্রি করার হাঁক দিচ্ছে সেই ছেলেটা – “শাড়ি নেবে গো, শাড়িইইই... বাংলার খাঁটি তাঁত, জামদানি আছেএএএ...”। এই হাঁক শুনে কেউ কেউ সদর দরজায় ভিড় জমাতেন, কেউ আবার ছেলেটিকে দেখে দরজা বন্ধ করে দিতেন। হার মানেনি সেই একরোখা ছিপছিপে ছেলেটি। কারণ সে জানত, এই পরিশ্রমের নামই সাফল্য। ঘামের দামের মূল্য সবাই বোঝে না। মুচকি হাসত শুধু। আজও এই হাসি লেগে আছে তাঁর মুখে। একটা চওড়া হাসি। বয়স বেড়েছে। সাফল্য এসেছে। কারণ ২০২১ সালের ‘পদ্মশ্রী’ সম্মানে ভূষিত হয়েছেন তিনি। তিনি শান্তিপুরের তাঁতশিল্পী বীরেনকুমার বসাক। মাত্র এক টাকা দিয়ে শুরু করেছিলেন পথ হাঁটা, আর আজ বছরে পঁচিশ কোটি টাকার টার্নওভার।
শান্তিপুরের ফুলিয়ার বসাক পাড়া। ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসের আগের দিন রাত্রে এই সুখবরটি আসে তাঁর কাছে। বিশ্বাস করার মতো নয়। একের পর এক শুভেচ্ছা বার্তায় বিশ্বাস করেন বীরেনবাবু, শিল্পে এবারের ‘পদ্মশ্রী’ তাঁর হাতে। তবে এই পুরস্কারই প্রথম নয়। এর আগে রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পেয়েছেন, পেয়েছেন জাতীয় পুরস্কারও। এমনকি নাম উঠেছে গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসেও। এখন বীরেনবাবুর বয়স সত্তর ছুঁইছুঁই।
তাঁর নিপুণ হাতে শোভা পেয়েছে জামদানি। নিজস্ব ঢঙে জামদানির উপর একের পর নকশা এবং শৈল্পিক কারুকার্যে তাঁর হাতের শাড়ি পৌঁছে গেছে বাংলার সীমানা পেরিয়ে বিদেশের মাটিতেও। বীরেনবাবুর জন্যই কিন্তু ফুলিয়ার তাঁতশিল্প নিজের পায়ে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছে। মাত্র পনেরো বছর বয়সে তাঁত বোনার কাজে হাতেখড়ি হয়। শুরুতে নিজেই তাঁত বুনতেন। ৪৮ বছর ধরে জামদানি নিয়ে কাজ করছেন। খাদি, মটকা, তসর, সিল্ক, মসলিন-সহ একাধিক কাপড়ের উপর নানানরকম নকশা ফুটিয়ে বাংলার শাড়িকে করে তুলেছেন একেবারে আটপৌরে। ১২,৭৮০ খানা সুতো এবং ৭০০-৮০০ রকম রং ব্যবহার করে প্রতিদিন শাড়িকে করে তুলছেন আরামদায়ক।
‘পদ্মশ্রী’ ঘোষণা হওয়ার পর সংবাদমাধ্যমকে বীরেনকুমার বসাক জানিয়েছেন, এই মুহূর্তে তাঁর সঙ্গে ৫,০০০ তাঁতশিল্পী রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ২,০০০ মহিলা। তাঁরা এখানে কাজ করে আজ স্বনির্ভর। এই পুরস্কার আসলে তাঁদেরই। ষাটের দশকে বাংলাদেশ থেকে ভারতে চলে আসতে হয়েছিল তাঁকে। পড়াশোনাও খুব একটা হয়নি। ১৩ বছর বয়স থেকে তাঁতশিল্পী হিসাবে কাজ শুরু করেন। তখন দৈনিক আয় ছিল আড়াই টাকা। বীরেনবাবু মসলিনের উপর তৈরি করেছেন সম্মানীয় ব্যক্তিত্বদের প্রতিকৃতি।
সূত্র: জি নিউজ
বিডি প্রতিদিন/ফারজানা