রবিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০১৪ ০০:০০ টা
তিস্তা পাড়ের দুঃখ

ব্যারাজের পর মূল নদীই পানিশূন্য পেশায় নেই জেলেরা

ব্যারাজের পর মূল নদীই পানিশূন্য পেশায় নেই জেলেরা

তিলোত্তমা নদী তিস্তা। এ নদীকে কেন্দ্র করেই সৃষ্টি করা হয়েছে দেশের সবচেয়ে বড় সেচ প্রকল্প। আর এ প্রকল্পে লাভবান হয়েছে উত্তরের জেলা নীলফামারী, দিনাজপুর ও রংপুরের লাখো কৃষক। কিন্তু যে জেলা দিয়ে এ তিস্তা প্রবাহিত সেই লালমনিরহাটের জন্য তিস্তা হয়ে উঠেছে অভিশাপ।
তিস্তার প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে লালমনিরহাটবাসী। এ জেলার পাঁচ উপজেলা হাতীবান্ধা, পাটগ্রাম, কালীগঞ্জ, আদিতমারী ও সদরের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে এ নদী। নদী হলেও গোটা শীত মৌসুম এটি থাকে প্রায় পানিবিহীন। কারণ নদীর পানিটুকু আটকে রাখা হয় তিস্তা ব্যারাজে। ফলে পানি না পেয়ে লালমনিরহাটের লাখো কৃষক দেড় যুগ ধরে রবিশস্য থেকে বঞ্চিত। এসব এলাকার মানুষ ধান, গম, ডাল, তামাকসহ বিভিন্ন রবিশস্য চাষাবাদ ভুলেই গেছেন। অনেকটা বাধ্য হয়েই ভুট্টা চাষের দিকে ঝুঁকছেন কৃষকরা। কারণ এতে পানি খরচও কম। চলতি মেয়াদে লালমনিরহাট, রংপুর, কুড়িগ্রাম, নীলফামারীর ৪৩টি ইউনিয়নের ১ লাখ ২০ হাজার হেক্টর জমিতে ভুট্টা চাষ করা হয়েছে বলে জানা গেছে। সব মিলিয়ে দুঃখ-কষ্টেই দিন কাটছে তিস্তাপারের মানুষের। তারা ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে ‘তিস্তা চুক্তি’ বাস্তবায়ন হলে সব সমস্যার সমাধান হতো- এমনটাই মনে করেন। এ হিস্যা আদায়ে সরকার, বিরোধী দলসহ সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বানও জানান তারা। এসব এলাকায় জীববৈচিত্র্যও ধ্বংসের মুখোমুখি বলে জানিয়েছেন পরিবেশবিদেরা। একই কারণে জেলার সহস াধিক জেলেও তাদের পেশা বদল করতে বাধ্য হয়েছেন। নিু আয়ের মানুষের নদী থেকে পাথর তোলাও বন্ধ দীর্ঘদিন ধরে। ফলে দরিদ্র শ্রেণী ক্রমান্বয়ে আরও দরিদ্র ও বেকার হয়ে পড়ছে। অবশ্য প্রশাসন ও রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের যোগসাজশে কিছু লোক গোপনে নদী থেকে পাথর তুলছে বলে জানা গেছে। তিস্তা সেচ প্রকল্পের ১ নম্বর ক্যানেলের চাষি লালমনিরহাটের তৌহিদুল ইসলাম, শফিকুল ইসলাম, জামিয়া রহমান, মকবুল হোসেন ও আবদুর রহমান। এ বছর শুষ্ক মৌসুমে অনেকটা ঝুঁকি নিয়ে ইরি ধানের চাষ করেন। বীজ লাগানোর সময় যে পানি পাওয়ার কথা ছিল, তা কিছুতেই পাওয়া যায়নি বলে অভিযোগ করেন তারা। ফলে ইরি ফসল নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছেন। পানির অভাবে কৃষি জমি ফেটে চৌচির হয়ে গেছে। উপায়ান্তর না পেয়ে স্যালো মেশিন দিয়ে জমিতে পানি সেচ দেন তারা। এতে খরচও গুনতে হয়েছে চার গুণ। মোট খরচের ফসল পাবেন কি না তা নিয়েও সন্দেহ ও সংশয় দেখা দিয়েছে। পানিশূন্যতার কারণে ধান ছাড়াও কোনো রবিশস্যের চাষেও আগ্রহ নেই তাদের। কৃষক তৌহিদুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বিএনপি যেমন লংমার্চ করতে না করতেই ভারত তিস্তায় পানিপ্রবাহ বৃদ্ধি করেছে, তেমনি ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলনের মাধ্যমে পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় করাও সম্ভব। তিস্তা নিয়ে কোনো রাজনীতি নয়, ঐক্যবদ্ধভাবে সরকার, বিরোধী দলসহ সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
তিস্তার পুবপাড়ে লালমনিরহাটের হাতীবান্ধার বাসিন্দা আবদুল মোতালেব। পেশায় কৃষিজীবী। তিনি পাঁচ একর জমির চার একরে ভুট্টা করেছেন। কারণ হিসেবে জানান, ধু-ধু বালুচরে ধান চাষ হয় না। ভুট্টা চাষে পানিও তুলনামুলক কম লাগে। খরচও কম। এক একর জমিতে ধান চাষ করার কথা জানালেও এর ফসল পাওয়ার অনিশ্চয়তায় রয়েছে। তা ছাড়া ধান চাষে যত টাকা খরচ হয়েছে তার খরচও উঠবে না বলে জানান। তিস্তাসংলগ্ন বাইশপুকুর গ্রামের জেলে তফা মামুদ। ‘মরা’ নদীতে যান না অনেক দিন ধরে। এখন পেশা বদল করে ভ্যান চালাচ্ছেন।
একই অবস্থা তিস্তাসংলগ্ন চরের আবদুল মতিন, খালিশা চাপানী গ্রামের ফরিদ, আমজাদ, ঝুনাগাছা চাপানী গ্রামের আলী হোসেন, আবদুস কুদ্দুস, টেপাখড়িবাড়ী গ্রামের সরেন রায়, জগদীশসহ অনেকের। তারাও এখন পেশা বদল করেছেন। নদীতে পানি না থাকায় পেটের তাগিদে পেশা বদল করতে হয়েছে বলে জানান জেলেরা। তিস্তা ব্যারাজ এলাকার বাসিন্দারা জানান, বর্তমানে উজানে ভারত অংশে ‘গজলডোবা’ ব্যারাজের সব গেট বন্ধ। ভারত ওই ব্যারাজের মাধ্যমে পানি ঘুরিয়ে নিজেদের কাজে লাগাচ্ছে।
এদিকে ভাটির যে যৎসামান্য অংশে পানি আসছে তাতে মাছ ধরার জন্য জালও ফেলতে পারছেন না জেলেরা। একাধিক জেলে জানান, একসময় এ নদীতে প্রচুর মাছ পাওয়া যেত। দেশি-বিদেশিসহ নানা প্রজাতির মাছ ধরা পড়ত। এখন তিস্তা নদী মাছশূন্যও হয়ে গেছে। অনেক জেলেপরিবারে দিন কাটছে এক বেলা খেয়ে-না খেয়ে। দিন দিন নদীর নাব্য হারিয়ে যাওয়ায় অনেকেই বাপ-দাদার এ পেশা ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন বলে জানান। এ প্রসঙ্গে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) নীলফামারীর দোয়ানী-ডালিয়ার নির্বাহী প্রকৌশলী মাহবুবর রহমান জানান, তিস্তার পানি চুক্তি বাস্তবায়িত হলে দেশের উত্তরাঞ্চলের আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব হতো। কৃষকদের মুখে হাসি ফুটত। কারণ তিস্তাসংলগ্ন ছয়টি জেলার ভাগ্য অনেকাংশে নির্ভর করে এর ওপর। নদীতে পানি না থাকায় এসব এলাকার জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে বলেও জানান তিনি।

 

সর্বশেষ খবর