সোমবার, ৭ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

ধরাছোঁয়ার বাইরে মুদ্রা পাচারকারীরা

মির্জা মেহেদী তমাল

ধরাছোঁয়ার বাইরে মুদ্রা পাচারকারীরা

কয়েকদিন আগের ঘটনা। শাহজালাল বিমানবন্দরের রপ্তানি ভিলেজ থেকে আলু করলা আর কাঁকরোলের কার্টন থেকে এক কোটি ৬৫ লাখ টাকার সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা জব্দ করে বিমানবন্দর কাস্টমস। এ ঘটনায় একজন গ্রেফতার হলেও তিনি এখন জামিনে মুক্ত। গত ২৭ এপ্রিল বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজ থেকে সবজির কার্টনে প্রায় কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা উদ্ধার করা হয়। এর এক সপ্তাহ আগে ১ কোটি ২২ লাখ টাকার সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আটক করে কাস্টমস। মালয়েশিয়াগামী বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইটের দুই যাত্রী লিটন শেখ ও আনজুম আরার চালের ব্যাগ থেকে বেরিয়ে আসে ৫০ লাখ টাকার বৈদেশিক মুদ্রা। চাল ডালের ভেতর বৈদেশিক মুদ্রা নিয়মিত পাচার করত বলে জেরার মুখে ওই দুই যাত্রী জানিয়েছেন। ঘটনাটি গত ১০ আগস্টের। সবজি রপ্তানির আড়ালে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে প্রায় প্রতিদিনই এভাবে বিপুল অঙ্কের  বৈদেশিক মুদ্রা পাচার হচ্ছে। শুল্ক বিভাগের হিসাবে গত এক বছরে চাল, আলু, কাঁকরোল, কচুর লতি, বরবটি, কাঁচামরিচ, করলা, ঢেঁড়সসহ বিভিন্ন সবজির ভেতরে হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা পাচার করা হয়েছে। আর এ পাচার কাজে হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরে শক্তিশালী ১৪টি সিন্ডিকেট সক্রিয়। এসব মুদ্রা যাচ্ছে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, দুবাই, সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশে। সংশ্লিষ্টরা বলছে, ভারতীয় মাড়োয়ারি ও এ দেশের ধনাঢ্য কিছু ব্যবসায়ী মুদ্রা পাচারের সঙ্গে জড়িত। আর এ কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে বাংলাদেশি নাগরিক ছাড়াও পাকিস্তান, ভারত এবং আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের। বিমানবন্দর সিভিল এভিয়েশন, বিমান, ব্যাংক, কাস্টমস, মানি এক্সচেঞ্জ, সিএন্ডএফ-এর সহায়তায় মুদ্রা পাচারের ঘটনা ঘটছে। কেবল বনিবনা না হলেই মাঝে মধ্যে দু-একটি ছোট চালান বাহকসহ ধরা পড়ে। এসব পাচারের ঘটনার অধিকাংশ মামলাই ধামাচাপা পড়ে গেছে। ফলে মূল হোতারা রয়ে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে।

গত এক বছরে পাচারের সময় দুই হাজার কোটি টাকারও বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আটক করা হয়েছে। এসব ঘটনায় বাহক হিসাবে সিভিল এভিয়েশন কর্মচারী, বিমান ক্রু, সিএন্ডএফের কর্মচারী গ্রেফতার হয়েছেন। এ ছাড়া আরও গ্রেফতার হয়েছেন পাকিস্তান, ভারত ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের নাগরিক।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বৈদেশিক মুদ্রা পাচারের ফলে দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে। চাহিদা ও জোগানের মধ্যে ভারসাম্য থাকছে না। কিন্তু এর বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি। পুলিশ বলছে, পাচারের ঘটনাগুলোর ব্যাপারে থানায় মামলা হলেও তদন্ত করতে গিয়ে তাদের বিপাকে পড়তে হচ্ছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর কাছ থেকে সহায়তা খুব একটা পাওয়া যায় না। ফলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তদন্ত ঝুলে থাকে। কাস্টমস সূত্র জানায়, সেপ্টেম্বরে বিমানবন্দরের রপ্তানি কার্গো ভিলেজে সবজির কার্টনের চালান থেকে ১ কোটি ৫৬ লাখ টাকার বৈদেশিক মুদ্রা জব্দ করে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। ঘটনার সঙ্গে জড়িত অভিযোগে আল হেলাল মোহন, মোতালেব হোসেন ও বদরুল হোসেন নামে মুদ্রাপাচার চক্রের তিন সদস্যকে আটক করে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। এ ঘটনায় বিমানবন্দর থানায় একটি মামলাও হয়। আটকদের জিজ্ঞাসাবাদে পিলে চমকানো তথ্য পায় পুলিশ। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী প্রায় প্রতিদিনই সবজিপণ্যের ভেতর ডলার, সৌদি রিয়াল, দিরহাম, কাতার রিয়াল, পাউন্ড ও ইউরো বিদেশে পাচার হচ্ছে হরদম। এরপরও সিঅ্যান্ডএফ প্রতিষ্ঠান তাহোরা ইন্টারন্যাশনালের কর্মচারী মোতালেব জামিনে মুক্ত হয়েছেন। কাস্টমস কর্মকর্তা, পুলিশ, বিভিন্ন গোয়েন্দাসহ তদন্ত সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মুদ্রা পাচারকারীরা এতটাই প্রভাবশালী যে, তাদের গ্রেফতার দূরের কথা, কর্মচারীরা ধরা পড়লেও জামিনে মুক্তি পেয়ে যান। কার্গো ভিলেজ থেকে সর্বশেষ যে বৈদেশিক মুদ্রার চালান ধরা পড়ে, এর গন্তব্য ছিল সিঙ্গাপুর। পুলিশ ও কাস্টমস সূত্র বলেছে, তাদের তদন্তে পাচারে জড়িত থাকা বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের নাম বেরিয়ে আসে। ১ কোটি ৫৬ লাখ টাকার বৈদেশিক মুদ্রাপাচারে রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান ঢাকা ট্রেড লিংক, সবজি রপ্তানিকারক কামরুল ইসলামের ইন্টারপোর্ট, আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান মো. খোরশেদের মালিকানাধীন হিমালয় ট্রেড এবং ফয়েজ আহমেদের মালিকানাধীন সিঅ্যান্ডএফ প্রতিষ্ঠান তাহোরা ইন্টারন্যাশনাল সরাসরি জড়িত। মামলায় এদের আসামি করা হয়। সূত্র জানায়, মামলার আসামি হলেও এদের গ্রেফতার করা সম্ভব হয় না।

অথচ এরা এখনো প্রকাশ্যে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। সবজির আড়ালে পাচার করছে বিপুল অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা। এ ব্যাপারে ঢাকা কাস্টম হাউসের যুগ্ম-কমিশনার এস এম সোহেল রহমান জানান, সবজি রপ্তানির আড়ালে বেশ কয়েকটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট দেশ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা বিদেশে পাচার করছে। তাদের ওপর নজর রাখা হচ্ছে। একটি তালিকাও পুলিশের কাছে দেওয়া হয়েছে। বিমানবন্দর থানার ওসি কামাল উদ্দিন বলেছেন, মুদ্রা পাচারের ঘটনায় যেসব সিন্ডিকেটের নাম এসেছে, তাদের ধরতে পুলিশের অভিযান চলছে। তবে গ্রেফতার এড়াতে তারা আত্নগোপন করেছে।

সর্বশেষ খবর