প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বই পড়ার অভ্যাস তরুণদের বিপথগামিতা থেকে রক্ষা করবে। বিপথে যাওয়া ছেলেমেয়েরা সাহিত্য ও সংস্কৃতির চর্চার মধ্য দিয়ে সুপথে ফিরে আসবে বলে বিশ্বাস করি। বই দিয়ে ছেলেমেয়েদের বিপথে যাওয়া থেকে উদ্ধার করা যায়। প্রধানমন্ত্রী গতকাল ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’র উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ভাষণ দিচ্ছিলেন। একই সময় প্রধানমন্ত্রী চার দিনব্যাপী ‘আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলন-২০১৭’ উদ্বোধন করেন।
পরে স্টলগুলো পরিদর্শন করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। আজ পর্যন্ত যা কিছু অর্জন তা রক্ত দিয়েই অর্জন করতে হয়েছে। নিজের ভাষা, কথা বলার অধিকার, বাঙালি হিসেবে যে মর্যাদার মধ্য দিয়ে আমরা পেয়েছি সবই লড়াইয়ের এবং রক্তের বিনিময়ে পাওয়া। তিনি বলেন, সেই অর্জন ভূলুণ্ঠিত হয়েছিল ’৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে। পরবর্তীতে আমরা মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদেরসহ সব ষড়যন্ত্রকারীর বিচার করতে সক্ষম হয়েছি। এ সময় বিশ্ব দরবারে আবারও বাঙালি হিসেবে নিজেদের অর্জনগুলো তুলে ধরেন তিনি। এ সময় বাংলা ভাষাকে বিশ্ব দরবারে ছড়িয়ে দিতে প্রকাশকদের তাগিদ দেন প্রধানমন্ত্রী।
ডিজিটাল বইয়ের লাইব্রেরি হাতের নাগালে থাকলেও এখনো তিনি হাতে নিয়ে পাতা উল্টে বই পড়াতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, হাতে নিয়ে পাতা উল্টে বই পড়াতেই আনন্দ বেশি। তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের বই পড়তে হবে। পরিবারগুলো তাদের শিশুদের বইয়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার মধ্য দিয়ে তার বিকাশে সহযোগিতা করে। তিনি নিজেও তার পরিবারের সদস্যদের জন্য ছোট থেকেই বই পড়ার চর্চা তৈরির পরিবেশ কীভাবে গড়ে তোলেন সেই বর্ণনা দেন।প্রধানমন্ত্রী বলেন, যারা বইপ্রেমী তারা অপেক্ষায় থাকেন কখন আমাদের এই বইমেলা শুরু হবে। এ বইমেলার মধ্য দিয়ে যারা সাহিত্যচর্চা করেন তাদের বই প্রকাশ হয়। এটা লেখক, প্রকাশক ও পাঠকদের বিরাট মিলনমেলা। তিনি আরও বলেন, একুশের গ্রন্থমেলা আন্তর্জাতিক সাহিত্য অনুষ্ঠান। আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলন ও এই গ্রন্থমেলা বিশ্বব্যাপী পরিচিত। বিদেশি অতিথিদের বাংলা বক্তৃতা, কবিতার অনুবাদ শোনানোয় তিনি উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে বলেন, অনুবাদের মধ্য দিয়ে ভাষা ও সংস্কৃতির আদান-প্রদানের সুযোগ হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানান, তার একটাই দুঃখ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যাওয়ার ফলে এখন আর আগের মতো বইমেলায় আসতে পারেন না। তিনি বলেন, হাত-পা বাঁধা কী করব। এটাই হচ্ছে সবচেয়ে দুঃখের। তিনি বলেন, আমি যখন দেখি সবাই বইমেলায় আসে তখন আমার মনটা পড়ে থাকে বইমেলায় আর আমি পড়ে থাকি বন্দীখানায়। এ সময় বন্দীখানার ব্যাখ্যা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বন্দীখানা বললাম এ জন্য যে, যখন কারাগারে ছিলাম তখন সেটা ছিল ছোট কারাগার। কিন্তু এখন যেহেতু একটি রাষ্ট্রের দায়িত্বে আছি সরকার প্রধান হিসেবে। এ জন্য কিছু নিয়মকানুন মেনে চলতে হয়, কাজেও ব্যস্ত থাকতে হয়। তারপরেও বই পড়ার ভিতর থেকে যে আনন্দ এবং বই পড়লে অনেক কিছু ভুলে থাকা যায়। আবার অনেক জ্ঞান অর্জন করা যায়।
মেলার উদ্বোধন শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার-২০১৬’ পুরস্কার বিতরণ করেন। কবিতায় আবু হাসান শাহরিয়ার, কথাসাহিত্যে শাহাদুজ্জামান, প্রবন্ধে মোর্শেদ শফিউল হাসান, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সাহিত্যে ড. এম এ হাসান, আত্মজীবনী ও স্মৃতিকথা বিষয়ক রচনার জন্য নূরজাহান বোস, শিশু সাহিত্যে রাশেদ রউফ এবং অনুবাদে ড. নিয়াজ জামান ‘বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার-২০১৬’ লাভ করেন। তারা সবাই প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে পুরস্কার গ্রহণ করেন। এবারের গ্রন্থমেলায় বাংলা একাডেমি প্রকাশ করছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু রচিত ‘কারাগারের রোজনামচা’ নামের ঐতিহাসিক গ্রন্থ। বাংলা এবং ইংরেজি উভয় ভাষাতেই এটি প্রকাশ হয়েছে। অসমাপ্ত আত্মজীবনীর পরে এটিই বঙ্গবন্ধু রচিত দ্বিতীয় কোনো গ্রন্থ। বইটিতে বাঙালির অধিকার আদায়ে কারান্তরীণ থাকার সময় বিভিন্ন বিষয় বঙ্গবন্ধু দৈনিক কর্মকাণ্ড হিসেবে ডায়েরিতে লিপিবদ্ধ করেন। এ ছাড়া, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রচিত ‘নির্বাচিত প্রবন্ধ’ও বইমেলায় প্রকাশ হয়েছে। অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর হাতে বাংলা একাডেমি প্রকাশিত মীর মশাররফ হোসেনের অমর সৃষ্টি ‘বিষাদ সিন্ধু’র অনুবাদ ‘ওসেন অব সরো’ এবং ‘হানড্রেড পোয়েমস ফ্রম বাংলাদেশ’ বই দুটি তুলে দেওয়া হয়। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। বিদেশি অতিথি হিসেবে চীনের প্রখ্যাত গবেষক ও রবীন্দ্র অনুবাদক ডং ইউ চেন, অস্ট্রিয়ার মেনফ্রেড কোবো, পুয়ের্তোরিকোর মিঁজ লুস মারিয়া লোপেজ ও ভারতের চিন্ময় গুহ বক্তৃতা করেন। বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন। অনুষ্ঠানে জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী, সরকারের মন্ত্রিপরিষদ সদস্যবৃন্দ, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাবৃন্দ, সংসদ সদস্যবৃন্দ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকসহ বিভিন্ন পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যগণ, সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাবৃন্দ, বিভিন্ন কূটনৈতিক মিশন ও দূতাবাসের কর্মকর্তাবৃন্দ, দেশবরেণ্য ব্যক্তিত্বগণ, কবি, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের শীর্ষ ব্যক্তিত্বরা উপস্থিত ছিলেন।