শিরোনাম
বুধবার, ৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

রোহিঙ্গাতে এলোমেলো কক্সবাজার

টেকনাফ-উখিয়ায় পাহাড় গাছ কেটে আশ্রয় শিবির • জড়াচ্ছে ভয়ঙ্কর অপরাধে • সন্ধ্যার পর রাস্তাঘাট ফাঁকা • মাইলের পর মাইল রাস্তার পাশে শিশু আর মহিলাদের অবস্থান

মির্জা মেহেদী তমাল, কক্সবাজার থেকে ফিরে

রোহিঙ্গাতে এলোমেলো কক্সবাজার

আশ্রয়ের অপেক্ষায় মহাসড়কে রোহিঙ্গাদের অবস্থান। উখিয়ায় চলছে গাছ কেটে আশ্রয় শিবির বানানোর কাজ —বাংলাদেশ প্রতিদিন

মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের চাপে কক্সবাজার জেলা এখন এলোমেলো। বিশেষ করে টেকনাফ ও উখিয়ার বন-জঙ্গল, পথঘাট যেদিকেই চোখ যায় শুধু রোহিঙ্গা আর রোহিঙ্গা। সরকারি খাসজমি ও বনভূমিতে তারা অবৈধ বসতি গড়তে শুরু করেছেন। তাদের থাকার জন্য উখিয়ায় বনের গাছপালা এবং একের পর এক পাহাড় বিনাশ করে গড়ে তোলা হয়েছে হাজার হাজার বস্তিঘর। এ ছাড়া উখিয়া থেকে টেকনাফের দীর্ঘ সড়কপথের দুই পাশে সারিবদ্ধভাবে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দেখা যায়। এরা ভোর থেকে রাত পর্যন্ত রাস্তার দুই ধারেই বসে থেকে ভিক্ষা করেন। এ দুটি উপজেলা ছাপিয়ে রোহিঙ্গারা ছড়িয়ে পড়েছেন পর্যটননগরী কক্সবাজারে। সেখানকার অলিগলি, রাজপথে অবস্থান নিয়েছেন তারা। কেউ ভিক্ষা করছেন, আবার কেউ দিনমজুরি। আবার অনেকেই ছিনতাই-ডাকাতিসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়েছেন। গত কয়েক দিনে সীমান্তবর্তী টেকনাফ, উখিয়া, রামু, কক্সবাজারসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে এমন চিত্র। সরেজমিনে জানা যায়, এই শরণার্থীদের সামনে রেখে উখিয়া, টেকনাফ আর কক্সবাজারে গড়ে উঠেছে দালাল চক্র, যারা রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আসতে সহযোগিতা করছে মোটা অঙ্কের বিনিময়ে। পাহাড় কেটে রোহিঙ্গাদের ভাড়া দিচ্ছে এই দালালরাই। সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সে দেশের সেনাবাহিনীর নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে থাকেন এসব রোহিঙ্গা। বাংলাদেশ-মিয়ানমারের সঙ্গে ২৭৪ কিলোমিটারের সীমান্ত রয়েছে। বিশাল এ সীমান্ত এলাকার গহিন জঙ্গল, নাফ নদ ও সমুদ্রপথ পাড়ি দিয়ে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেন। এখনো প্রতি রাতে দল বেঁধে শত শত রোহিঙ্গা টেকনাফের লেদা ও উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্পে আসছেন। তবে এসব ক্যাম্পের রোহিঙ্গাদের ঘরে জায়গা না থাকায় অনেককেই খোলা আকাশের নিচে রাত যাপন করতে দেখা গেছে। গত তিন মাসে টেকনাফ ও উখিয়ার সীমান্ত দিয়ে কতসংখ্যক রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঘটেছে, এর সঠিক তথ্য কারও জানা নেই। তবে সংশ্লিষ্টদের ধারণা, এ সংখ্যা ৬০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে।

নিরাপত্তা-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শুধু কক্সবাজারের নয়, এ রোহিঙ্গাগোষ্ঠী গোটা বাংলাদেশের জন্যই বড় সমস্যা। তারা ইয়াবা পাচার, চোরাচালান, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদে সরাসরি জড়িত। বাংলাদেশি সেজে তারা স্থানীয় শ্রমবাজার দখল করে আছেন। এমনকি বাংলাদেশি ভোটার আইডি কার্ড গ্রহণ করে নাগরিকও বনে যাচ্ছেন অনেকে। ২৭ জানুয়ারি বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করা একটি পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা হয়। আট সদস্যের ওই পরিবারের মধ্যে পুরুষ ছিলেন একজন। বাকিরা নারী ও শিশু। এরা উখিয়ার সীমান্ত হয়ে সেদিনই বাংলাদেশে ঢুকেছেন। উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের পামেল নামে একটি পাহাড়ে নতুন করে কয়েকটি ঘর তৈরি করা হচ্ছে তাদের জন্য। আমিনা বেগম নামে এক রোহিঙ্গা নারী বলেন, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও স্থানীয় মগদস্যুদের হামলায় সর্বস্ব হারিয়ে তারা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছেন। তিনি হারিয়েছেন স্বামী ও ভাইকে। সীমান্ত এলাকা পার হওয়ার জন্য অন্তত ২০ দিন মিয়ানমার সীমান্তের কুমিরখালীর গহিন পাহাড়ে লুকিয়ে থাকতে হয় তাকে। সেখান থেকে রাতে আকবর নামে একজন দালালের মাধ্যমে বিজিবির চোখ ফাঁকি দিয়ে উখিয়ায় এসেছেন তিনি। এজন্য আকবরকে ৩ হাজার টাকা দিতে হয়েছে।

স্থানীয়রা জানান, রোহিঙ্গাদের শুধু ঘর ভাড়া নয়, বিভিন্নভাবে তাদের আশ্রয় দিয়ে দালালচক্র দিনমজুরি কাজের জন্য বিক্রি করে দিচ্ছে। তাদের বিক্রি করা হচ্ছে দৈনিক ২৫০ থেকে ৫০০ টাকায়। কিন্তু ওই রোহিঙ্গাদের দেওয়া হচ্ছে দৈনিক ১৫০ থেকে ২৫০ টাকা। সরদার হিসেবে বাকি টাকা নিয়ে নিচ্ছেন স্থানীয় আশ্রয়দাতা। কুতুপালং অস্থায়ী রোহিঙ্গা ক্যাম্পের অদূরের একটি পাহাড়ের নিচে বিশাল অংশ কেটে অস্থায়ী ঘর তৈরি করছিলেন কয়েকজন শ্রমিক। জানতে চাইলে তারা বলেন, স্থানীয় মেম্বার বখতিয়ার রোহিঙ্গাদের রাখতে ঘরগুলো তৈরি করছেন। এর বাইরে তারা কিছু জানেন না। শ্রমিক হিসেবে দৈনিক ২০০ টাকা মজুরিতে তারা এখানে কাজ করছেন। ওই ক্যাম্প থেকে টেকনাফ-উখিয়া প্রধান সড়কের দিকে আসতে পুরনো দুটি পাহাড়ের নিচে আরও নতুন দুটি ঘর তৈরি করতে দেখা গেছে।

বনভূমি দখল করে বসতি : অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গারা পাহাড় কেটে, বনের গাছ উজাড় করে নতুন নতুন বস্তিঘর তুলছেন। এতে পরিবেশ বিপর্যয় ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে। উখিয়ায় সংরক্ষিত বনে রোহিঙ্গাদের অবৈধ বসতি উচ্ছেদ করতে গেলে বনকর্মীদের ওপর হামলার ঘটনাও ঘটে। বন বিভাগের উখিয়া রেঞ্জ কর্মকর্তা মনিরুল ইসলাম জানান, রোহিঙ্গারা উখিয়ার কুতুপালং এলাকায় নতুন করে আরও বনভূমি দখল করে ঝুপড়িঘর নির্মাণ করছিলেন। তাদের উচ্ছেদ করতে গেলে তারা ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে দা-ছুরি, লাঠিসোঁটা নিয়ে বনকর্মীদের ধাওয়া করেন। জেলা প্রশাসন জানায়, সব পাহাড়ে বসবাসকারীদের ৮০ ভাগই রোহিঙ্গা। বাকি ১০ ভাগ স্থানীয় ও অন্যান্য। এসব এলাকায় অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ, সরকারিভাবে রাস্তাও নির্মাণ করা হচ্ছে। এতে রোহিঙ্গারা মিয়ানমার ছেড়ে বাংলাদেশের পাহাড়ি এলাকায় থাকতে বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করছেন। প্রধান বন রক্ষকের কাছে পাঠানো কক্সবাজার বন বিভাগের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, অনিবন্ধিত রোহিঙ্গারা নিবন্ধিত ক্যাম্পের আশপাশে প্রতিনিয়ত বাগান নষ্ট করেন, আগুনে পুড়িয়ে, ঝুপড়িঘর নির্মাণ করছেন। তারা গাছের গুঁড়ি বিক্রি, কবরস্থান তৈরি ইত্যাদি কাজের মাধ্যমে বনভূমি দখলে লিপ্ত। এ সমস্যা আরও প্রকট হচ্ছে। বন বিভাগের তথ্যমতে, জেলার দক্ষিণ ও উত্তর রেঞ্জে বনভূমির আয়তন ২ লাখ হেক্টরের মতো। এসব বনভূমির বড় একটা অংশই দিন দিন রোহিঙ্গারা গিলে খাচ্ছেন।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর