মঙ্গলবার, ৭ মে, ২০১৯ ০০:০০ টা

ধানের ভিতর সুই

মির্জা মেহেদী তমাল

ধানের ভিতর সুই

তাদের কাছে থাকে ম্যাগনেটিক কয়েন। আর থাকে কিছু ধান। এই ধানের ভিতর কৌশলে তারা লুকিয়ে রাখে সুইয়ের ভাঙা অংশ। ম্যাগনেটিক কয়েন ধানের কাছাকাছি ধরা মাত্রই সুই দেওয়া ধান আকর্ষিত হয়। এ দৃশ্য দেখে হতবাক মানুষ। তাদের বলা হয় এই কয়েনে মহামূল্যবান ইউরেনিয়াম  আছে। তাদের ফাঁদে পা দেয় ধনাঢ্য ব্যক্তিরা। কোটি টাকার বিনিময়ে কিনে নেয় সেই কয়েন। অনেকেই আবার অগ্রিম হিসেবে তাদের ১০ থেকে ৫০ লাখ টাকা দিয়ে নিয়ে যেত। পরে যখন ক্রেতা বুঝতে পারে তিনি প্রতারণার শিকার হয়েছেন তখন আর কিছু করার থাকে না। প্রতারক চক্রের সদস্যরা তাকে না চেনার ভান করে। বাড়াবাড়ি করলে হত্যার হুমকি দেয়।

এই চক্রটি কখনো কাপড় বিক্রির এজেন্ট। বিভিন্ন কাপড় ব্যবসায়ীকে টার্গেট করে কার্যক্রম শুরু করে। তারা প্রথমে ভুয়া কোনো গার্মেন্ট ফ্যাক্টরির এজেন্ট হিসেবে ব্যবসায়ীদের দোকানে গিয়ে তাদের প্রয়োজন মতো কম দামে শাটিং কাপড় বিক্রির লোভনীয় অফার  দেয়। কয়েক হাজার গজ কাপড় বিভিন্ন স্থানে ফ্যাক্টরির গোডাউনে রাখা আছে বলে জানায়। ব্যবসায়ীরা লোভনীয় প্রস্তাবে রাজি হয়ে গোডাউনে রাখা শাটিং ফেব্রিক্স দেখে চুক্তিতে স্বাক্ষর করে ও মালামাল ক্রয়বাবদ অগ্রিম টাকা দেয়। পরে মালামাল আনতে গিয়ে জানতে পারেন, ভুয়া কোম্পানির মানি রিসিট দেওয়া হয়েছিল তার হাতে। পুরো প্রক্রিয়ায় তিনি প্রতারিত হয়েছেন।

এমন ভয়ঙ্কর প্রতারক চক্র এখন সারা দেশেই সক্রিয়। যাদের ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন শহরে রয়েছে বিলাসবহুল অফিস। চট্টগ্রাম বন্দরেও রয়েছে ভিআইপি অফিস। অফিসেই চলে তাদের প্রতারণা। তাদের খপ্পরে পড়ে সর্বস্বান্ত হয়ে পথে বসেছে অনেক ধনাঢ্য ব্যক্তি। এমন এক চক্রের সন্ধান পেয়েছে র‌্যাব।

আসাদ এন্টারপ্রাইজের মালিক মো. বাশার। তানভীর নামের একজনের মাধ্যমে তিনি বিদেশি শাটিং ফেব্রিক্স কিনতে রাজি হন। নিজে গাজীপুরে একটি গোডাউনে মালামালও দেখে আসেন। এরপর মহাখালীর ডিওএইচএস এলাকার এক অফিসে গত ৭ ফেব্রুয়ারি প্রথম কিস্তিতে ১০ লাখ টাকার চেক দেন তিনি। গত ৯ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর হোটেল ওয়েস্টিনে বসে আরও ২০ লাখ ৫০ হাজার টাকা দেন। কিন্তু মালামাল আনতে গিয়ে তিনি জানতে পারেন ওই মালামালের মালিক অন্য কেউ। তানভীরের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তাকে প্রাণনাশ ও মামলার হুমকি দেওয়া হয়। রাজধানীর মহাখালী ডিওএইচএসে চক্রটির বিলাসবহুল অফিস। চট্টগ্রাম বন্দরেও রয়েছে ভিআইপি অফিস। যেখানে ম্যাগনেটিক কয়েন, ম্যাগনেটিক পিলার, তক্ষক, শাটিন ফেব্রিক্স কাপড় এবং জাহারে স্ক্র্যাব ও লোহার গর্দা কম দামে বিক্রির কথা বলে হয় চুক্তি। এরপর বিদেশি গ্রাহকও সংগ্রহ করে দেওয়ার কথা বলে সচ্ছল ও ব্যবসায়ীদের প্রতারণার ফাঁদে ফেলে চক্রটি। বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন ও ভুয়া প্রমাণ রিপোর্ট দেখিয়েও চক্রটি বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি করে। এ প্রক্রিয়ায় গত ২০ বছরে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে প্রতারক চক্রটি।

সাড়ে ৩০ লাখ টাকা খোয়া যাওয়ার পর মো. বাশার অভিযোগ করেন র‌্যাবের কাছে। এরপর বুধবার রাতে রাজধানীর কাফরুল এলাকায় অভিযান চালিয়ে প্রতারক চক্রটির ১৫ সদস্যকে গ্রেফতার করে র‌্যাব-৪ ব্যাটালিয়ন। এ সময় তাদের কাছ থেকে প্রতারণার কাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন নথিপত্র ও ৩২টি মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়। গ্রেফতাররা হলেন- নুরুল ইসলাম (৩৭), মিনার মিয়া (৪২), মিজান (৫০), তোফাজ্জল করিম ওরফে তানভীর (৪১), আক্তার ফারুক (৪৩), রাজু (৪১), গোলাম মোস্তফা শাকিল (৪২), শাকিল খান (৩০), জাহাঙ্গীরুল আবেদীন (৪৫), আজগর আলী হাওলাদার (২৭), সিরাজুল ইসলাম (৪৫), শামিম মিয়া (৪০), অজয় চাকী (৪০), হারুন উর রশিদ (৪৭) ও তুষার আহমেদ (২০)। র‌্যাব-৪ এর অধিনায়ক (সিও) অতিরিক্ত ডিআইজি চৌধুরী মঞ্জুরুল কবীর বলেন, গ্রেফতারদের বিরুদ্ধে একাধিক প্রতারণার মামলা রয়েছে। রাজধানী ঢাকাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে চক্রটির প্রতারণার অফিস রয়েছে।

প্রতারক চক্রের সদস্যরা দেশের আর্থিক সচ্ছল ব্যবসায়ী ও উচ্চপদস্থ চাকরিজীবীদের টার্গেট করে পুরনো যুগের বিশেষ ধরনের কয়েন মহামূল্যবান, যার মূল্য প্রায় কয়েক শ কোটি টাকা বলে প্রচার করে। কয়েনগুলো বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন, প্রমাণস্বরূপ তারা ভুয়া রিপোর্ট দেখায়। ধানের ভিতর সুই ঢোকানো ছাড়াও আরও নানা কৌশলে ফাঁদ পাতে তারা। কয়েনের ওপর তারা বিশেষ ধরনের কেমিক্যাল প্রয়োগ করে তার ওপর ২৪-২৫ পিস ধান রেখে বিভিন্ন রং ধারণের পর একপর্যায়ে ধুলায় পরিণত করে দেখায়। কয়েনের ক্ষমতা দেখে প্রভাবিত হয় গ্রাহক। আরেক কথিত বিশেষজ্ঞকে ডেকে সাধারণ ও অসাধারণ কয়েন চিহ্নিত করে দেখায় চক্রটি। কয়েন বিক্রি করে বিদেশি গ্রাহকের কাছে বিক্রি করতে গিয়ে বুঝতে পারেন তাও ভুয়া। পাওয়ার কয়েনের ন্যায় প্রায় একই প্রক্রিয়ায় টার্গেটদের কাছে ম্যাগনেটিক পিলার কম দামে বিক্রি করে প্রতারণা করে চক্রটি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর