বছরখানেক আগে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ছেলের সঙ্গে ফেন্সির (ছদ্মনাম) ফেসবুকে পরিচয় হয়। রাতভর কথা। দিনের অর্ধেকটাই কাটে ঘুমে। একসময় ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। একপর্যায়ে ওই ছেলের অনুরোধে তারা মেসেঞ্জারে ভিডিও কল করে। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের কথাবার্তা যৌনতা নির্ভর হতে থাকে। তারা ভিডিও কলে নিজেদের পোশাক খুলে কথা বলতে থাকে। কিছুদিন যেতেই ছেলেটির আসল ইচ্ছা প্রকাশ পায়। ছেলেটি তার কাছে টাকা দাবি করতে থাকে। অন্যথায় সে ভিডিও কলের রেকর্ড করা সব কিছু ফাঁস করে দেবে বলে হুমকি দেয়। দিনের পর দিন মেয়েটি ব্ল্যাক মেইলিংয়ের শিকার হতে থাকে। বাসা থেকে যেভাবে পারছে টাকা নিয়ে প্রায় প্রতিদিনই বিকাশ করতে হয় ছেলেটির কাছে। এমন কোনো ঘনিষ্ঠ পরিচিত নেই যাদের কাছ থেকে টাকা লোন করেনি সেই শিক্ষার্থী। তার জমানো টাকা যা ছিল সব শেষ। সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ে মেয়েটি। কোনোভাবেই লেখাপড়ায় মন বসাতে পারে না। একসময় লেখাপড়াই বন্ধ হয়ে যায়। মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়তে থাকে মেয়েটি। এক পর্যায়ে বাধ্য হয়ে সে পুলিশের কাছে গিয়ে অভিযোগ করে। সমস্যা গুরুতর হওয়ায় পরিবারকে জানায় পুলিশ। মেয়েটির মনোচিকিৎসার প্রয়োজন পড়ে। সেই চিকিৎসা নেওয়া হয়।
ফেসবুকের মাধ্যমে পরিচয়ের সূত্রে অপরাধ সংঘটনের অভিযোগের এখন পাহাড় পুলিশের টেবিলে। ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে কিশোরী ও তরুণীর সংখ্যা বেশি। গভীর সম্পর্ক হওয়ার পর ব্ল্যাকমেইল করা হচ্ছে তাদের। প্রতারকদের কেউ কেউ ভুয়া আইডি ব্যবহার করছে। পুলিশের তথ্য-প্রযুক্তি নিরাপত্তা ও অপরাধ বিভাগ বলছে, প্রতিদিনই অনেক অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। এর মধ্যে রাজধানীর এক বিখ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এক ছাত্রীর অভিজ্ঞতা পুলিশকেও স্তম্ভিত করে দিয়েছে। পুলিশের তদন্তে উঠে এসেছে, ফেসবুকসহ ইন্টারনেটে সাইবার ক্রাইমের শিকার যারা হচ্ছে তাদের ৭০ শতাংশ নারী এবং তাদের বয়স ২৫ বছরের নিচে। প্রেম, বিয়েসহ নানা প্রেক্ষাপটে নারীদের ফেসবুক ফাঁদে ফেলে প্রতারিত করা হচ্ছে। এ ছাড়া মোবাইল ফোন হারানোর পর ‘ফেক আইডি’ ব্যবহার করে বিপাকে ফেলা হচ্ছে নারীদের। বিশেষ করে যেসব মোবাইল ফোন ছিনতাই হয় সেগুলো থেকে কৌশলে তথ্য বের করেও তাদের বিপদে ফেলা হচ্ছে বলে তদন্তসংশ্লিষ্ট এক পুলিশ কর্মকর্তা জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ফেসবুকে সব কিছু এখন আর সত্য নেই। ফেকবুক এখন ফেক আইডির ফেকবুকে পরিণত হয়েছে। জানা যায়, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ছয়টি সুপারিশ করে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) সদর দফতর। এসব সুপারিশে সামাজিক সচেতনতার পাশাপাশি ফেসবুকসহ ইন্টারনেট ব্যবহারের নানা বিষয় রয়েছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড ক্রাইম ডিভিশনের এক কর্মকর্তা বলেছেন, পরিস্থিতি যে পর্যায়ে যাচ্ছে সামাজিক প্রতিরোধ অপরিহার্য হয়ে উঠছে। পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, সাইবার ক্রাইমের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে উঠতি বয়সের ছেলে-মেয়েরা। যে কারণে বাবা-মাকে আরও সজাগ থাকতে হবে। ছেলে-মেয়েরা কার সঙ্গে চলছে, কার সঙ্গে ফেসবুকে কথা বলছেÑসব কিছুই জানতে হবে বাবা-মাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক তৌহিদুল হক বলেন, ফেসবুক একটা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। এটা ব্যবহারের আগে ভালোভাবে জেনে বুঝে নিতে হবে। তাহলে কোনোভাবেই একজন আরেকজনকে ফেসবুকের মাধ্যমে বিপদে ফেলতে পারবে না।