সোমবার, ২৬ আগস্ট, ২০১৯ ০০:০০ টা

মাদক গ্রহণে এগিয়ে খুলনা ব্যয়ে ঢাকা, ব্যবসায় বরিশাল

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের প্রতিবেদন

জিন্নাতুন নূর

বাংলাদেশের আটটি বিভাগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি খুলনার মানুষ মাদক গ্রহণ করেন। আর সারা দেশে মাদক সরবরাহের ক্ষেত্রে এগিয়ে আছে সিলেটের মানুষ। আট বিভাগের মধ্যে মাদক ব্যবসায় সবচেয়ে বেশি জড়িত বরিশালের মানুষ। তবে দৈনিক হিসাবে মাদক গ্রহণের দিক থেকে এগিয়ে আছেন ঢাকার মাদকাসক্তরা। রাজধানীর একজন মাদকাসক্ত গড়ে মাসে মাদকের পেছনে সবচেয়ে বেশি, কমপক্ষে ১১ হাজার ৩৩৪ টাকা খরচ করেন। এমনকি সংখ্যার হিসেবেও ঢাকায় অন্য বিভাগগুলোর চেয়ে শিশু মাদকাসক্তের হার সবচেয়ে বেশি। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব মেন্টাল হেলথের সর্বশেষ তথ্যে, দেশে বর্তমানে মাদকাসক্তের সংখ্যা ৭০ লাখ। এর মধ্যে ২৫ শতাংশের বয়স পনেরোর কম আর অর্ধেকের বেশি মাদকাসক্তের বয়স ৩০ বছরের কম। এ ছাড়া মোট মাদকাসক্তের মধ্যে ১০ শতাংশই, অর্থাৎ সাত লাখই নারী। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের ২০১৮ সালে ‘কজ অ্যান্ড ভিকটিম অব ড্রাগ অ্যাডিকশন অ্যান্ড ওয়ে ফরোয়ার্ড ফর এস্টাবলিশমেন্ট অব অ্যাডেকুয়েট ট্রিটমেন্ট অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন ফ্যাসিলিটিজ অ্যাট প্রাইভেট সেক্টর ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণা থেকে এমনটি জানা যায়। দেশের আটটি বিভাগের আড়াই হাজার মানুষের ওপর জরিপ চালিয়ে গবেষণা প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে।

প্রতিবেদন থেকে প্রাপ্ত তথ্যে, বর্তমানে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত দুটি মাদকদ্রব্য হচ্ছে গাঁজা ও ইয়াবা। মাদকাসক্তদের মধ্যে ৬৮.২ শতাংশই গাঁজা এবং ৪৮.২ শতাংশ ইয়াবা গ্রহণ করেন। দেশে মাদকাসক্তদের গড় বয়স ১৫ থেকে ৩০ বছর। বিভিন্ন ধরনের মাদকের মধ্যে ঢাকার মাদকাসক্তরা সবচেয়ে বেশি গ্রহণ করেন ইয়াবা (৮১.৩ শতাংশ)। আর মাদকদ্রব্যের মধ্যে বরিশালের মানুষ সবচেয়ে বেশি গ্রহণ করেন গাঁজা (৮৪.৮ শতাংশ)। রাজশাহীর মানুষ গ্রহণ করেন হেরোইন (৬৩.৮ শতাংশ)। অন্যদিকে রংপুরের মাদকাসক্তরা বেশি খান ফেনসিডিল (৫৩.৯ শতাংশ)। গবেষণা থেকে আরও জানা যায়, মাদকাসক্তদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠই (৪৮.১ শতাংশ) বিবাহিত। আর এদের অধিকাংশের মাদক গ্রহণের টাকা আসে ব্যবসায়িক আয় থেকে। গড়ে এই ব্যবসায়ীদের মাসিক আয় ১৭ হাজার ৬২২ টাকা। আর গড়ে মাসে মাদকের পেছনে তাদের কমপক্ষে খরচ হয় ৮ হাজার ৫৭৮ টাকা। দিনের হিসাবে গড়ে খরচ হয় ৩২৪ থেকে ৬১৯ টাকা। বছরে মাদকের পেছনে খরচ হয় ১ লাখ ১৮ হাজার ২৬০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ২ লাখ ২৬ হাজার ২১২ টাকা। আবার নিম্ন আয়ের মানুষ, যাদের মাসিক আয় ১৫ হাজার টাকার কম, তারা তুলনামূলক বেশি (৫৩ শতাংশ) মাদকাসক্ত। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, যে মাদকাসক্ত সন্তানের মা কর্মজীবী এবং বাবার পেশা ব্যবসা, তাদের মাদকাসক্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। এমনকি মাদক গ্রহণের ঝুঁকি বেশি উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানদের (২৫.৩ শতাংশ)। মাদক নেওয়ার ক্ষেত্রে ঢাকার উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানরা এগিয়ে। আবার যেসব পরিবারের সন্তানদের শুধু মায়েরা লালন-পালন করেন, তাদেরও মাদক গ্রহণের ঝুঁকি বেশি থাকে। মাদকাসক্তদের মধ্যে (৮২.৭ শতাংশ) শিক্ষিত। আর উচ্চশিক্ষিত বাবার সন্তানদের মাদক গ্রহণের হার কম। আবার যে মায়েদের শিক্ষা কম, তাদের সন্তানদের মাদক গ্রহণের হার বেশি। গবেষণা থেকে আরও জানা যায়, মাদকাসক্তদের মধ্যে ৫১.৭ শতাংশ পরিবারের সঙ্গে, ২৩.৮ শতাংশ স্ত্রী ও সন্তানের সঙ্গে, ৭.৫ শতাংশ ব্যাচেলর মেসে এবং ৯ শতাংশ রাস্তাঘাটে ছন্নছাড়া অবস্থায় থাকেন। আর ঢাকায় শিশু মাদকাসক্তের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি ১০.৭ শতাংশ। তবে খুলনায় শিশু মাদকাসক্ত সে অর্থে নেই। পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, দেশের মাদকাসক্তদের অর্ধেকই বেশির ভাগ সময় তাদের বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটান, নয় তো একাকী থাকেন। আর বন্ধুদের উৎসাহে মাদক নিতে শুরু করেন ৫৫.২ শতাংশ। মাদক গ্রহণের দ্বিতীয় কারণটি হচ্ছে নিজস্ব কৌতূহল। এ ছাড়া কিছু ক্ষেত্রে বিষণœতাও মাদকাসক্তির অন্যতম কারণ। বিষণœতার কারণে ২৫.১ শতাংশ মানুষ মাদক গ্রহণ করেন। এ ছাড়া পারিবারিক অশান্তি, সন্তানের প্রতি অবহেলা মাদক গ্রহণের অন্যতম আরেকটি কারণ। তবে দরিদ্র পরিবারের সন্তানরাও মাদকে উৎসাহিত হয়। আর সামাজিক কারণগুলোর মধ্যে ফেসবুক ব্যবহার এবং দীর্ঘ সময় ধরে চাকরি না পাওয়াও মাদক গ্রহণের বড় কারণ। এর বাইরে সম্পর্কে ব্যর্থতাকেও মাদক গ্রহণের জন্য চিহ্নিত করা হয়। গড়ে বাংলাদেশের মাদকাসক্তরা ২১ বছর বয়স থেকে মাদক গ্রহণ শুরু করেন। আর গড়ে ১০ বছর ধরে মাদকসক্তরা মাদক গ্রহণ করেন। সাধারণত মাদকাসক্তরা তাদের বন্ধু এবং মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে মাদক সংগ্রহ করেন। তারা মাদক ব্যবসায়ীদের বাড়ি, হোম ডেলিভারি ম্যান ও বস্তি এলাকা থেকে মাদক সংগ্রহ করে থাকেন। গবেষণা প্রতিবেদনটির জরিপে মাদকাসক্তরা জানান, বেশির ভাগই (৪২.২ শতাংশ) নিজ ঘরে মাদক গ্রহণ করেন। ঘর ছাড়াও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্যাম্পাস, খেলার মাঠ, রেলস্টেশন, বাসস্ট্যান্ড, পুরনো অব্যবহৃত ভবনে তারা মাদক গ্রহণ করে থাকেন। জরিপ প্রতিবেদন থেকে আরও জানা যায়, ৭৯.৯ শতাংশ গাড়ির চালক ও হেলপার মাদক গ্রহণ করে থাকেন। এ ছাড়া ৬৩.৯ শতাংশ বেকার যুবক মাদক গ্রহণ করেন। প্রতি পাঁচজন শিক্ষার্থীর তিনজনই মাদক গ্রহণ করেন বলে জানা যায়। এর মধ্যে বরিশালের শিক্ষার্থীরা সবচেয়ে বেশি (৯২.৬ শতাংশ) মাদক গ্রহণ করেন। এর বাইরে চাকরিজীবী, ক্ষুদ্র ও বড় ব্যবসায়ী এবং শ্রমিকরা কমবেশি মাদক গ্রহণ করেন। খুলনায় মাদক ব্যবসায়ীরা সবচেয়ে বেশি নিজেদের বাড়িতেই মাদক বিক্রি করেন। এর পরই ঘরে বা ব্যবসায়ীদের নির্ধারিত স্থানে মাদক বিক্রি করেন রংপুরের মাদক ব্যবসায়ীরা। এর মধ্যে কিছু ব্যবসায়ী আবার ফোন পেলে ঘরে মাদক পৌঁছে দেন। স্থানীয় বস্তিগুলোও মাদকের অন্যতম উৎস। এর বাইরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ক্যাম্পাসও মাদক সংগ্রহের অন্যতম স্পট। এ ক্ষেত্রে খুলনার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো মাদক প্রাপ্তির উৎসের দিক থেকে অন্য বিভাগের চেয়ে এগিয়ে আছে। পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি মাদক আসছে ভারত থেকে (৫২.৯ শতাংশ)। এরপর মিয়ানমার থেকে (৪৮.২ শতাংশ)। এর বাইরে নেপাল ও পাকিস্তান থেকে পরিমাণে অল্প হলেও বাংলাদেশে মাদক আসছে। জানা যায়, দেশের ৩২টি সীমান্ত-সংলগ্ন জেলা দিয়ে মাদক চোরাচালান হচ্ছে। আর মাদকের প্রাপ্তিস্থল হিসেবে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলো হচ্ছে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কক্সবাজার, রাজশাহী, পাবনা, বগুড়া, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, জয়পুরহাট, রংপুর, দিনাজপুর, খুলনা, বরিশাল, সাতক্ষীরা ও যশোর। মাদক গ্রহণের নেতিবাচক ফলাফল সম্পর্কে জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে (৪১.৩ শতাংশ) জানান, এর ফলে তাদের মানসিক অসুস্থতা দেখা দেয়। এর বাইরে বিভিন্ন উপসর্গের মধ্যে কাজে ও শিক্ষায় মনোযোগ কমে যাওয়া এবং অনিদ্রা দেখা দেওয়াসহ মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়। জরিপে অংশ নেওয়াদের ৩৯ শতাংশ জানান, এ জন্য তারা অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। আর ২২.৩ শতাংশ তাদের চারপাশে চুরির ঘটনা বৃদ্ধি পাওয়ার কথাও জানান। আবার মাদকাসক্তদের ৬৬.৮ শতাংশই চিকিৎসার জন্য কোনো পুনর্বাসন কেন্দ্রে ভর্তি হন না বলে জরিপে জানিয়েছেন।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর