রবিবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা
কেরানীগঞ্জে কারখানায় আগুন

পোড়াদের চিনতে পারছেন না স্বজনরা

নিজস্ব প্রতিবেদক

ঢাকার কেরানীগঞ্জে প্লাস্টিক কারখানার আগুনে দগ্ধ ৯ কর্মীকে চিনতে পারছেন না স্বজনরা। এদের কারও গলার কণ্ঠ, হাতের কাটা দাগ, বুকের চিহ্ন ও পরনের কাপড় দেখে শনাক্ত করা হয়েছে। আগুনে দগ্ধদের পুরো শরীর এতটাই বীভৎস হয়েছে যে, তাদের প্রত্যেককে  দেখতে একই রকম মনে হচ্ছে। চিকিৎসকরাও তাদের দেখে রীতিমতো আঁতকে উঠছেন। কেরানীগঞ্জের চুনকুটিয়ায় ‘প্রাইম প্লেট অ্যান্ড প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড’র বুধবারের আগুনে এ পর্যন্ত ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে একজন ঘটনাস্থলেই মারা যান। সর্বশেষ মারা গেছে ১৪ বছর বয়সী আসাদ নামে এক কিশোর। গতকাল সকাল পৌনে ৮টায় শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে মারা যায় সে।  শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের প্রধান সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন জানান, আসাদকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছিল। যে ১০ জনকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছিল, তাদের প্রত্যেকের অবস্থা খুবই খারাপ। আশঙ্কাজনক। এদের একজন সকালে মারা গেছেন। আর প্রত্যেকের মুখ ফুলে গিয়ে একই রকম হয়ে গেছে। কাউকে আলাদাভাবে চেনার উপায় নেই। আমাদের এখানের আইসিইউ ব্যবহার শুরু হয়েছে এই পোড়া রোগীদের চিকিৎসা দেওয়ার মাধ্যমে। তাদের শ্বাসনালিও খুব খারাপভাবে পুড়ে গেছে। ৯ জনেরই ৬০ থেকে ৮০ ভাগ পোড়া। দগ্ধ আরও ৮ জন ভর্তি আছেন বার্ন ইউনিটে। প্লাস্টিক কারখানায় ওই অগ্নিকান্ডে মারা গেছেন ইলেকট্রিশিয়ান বাবলু হোসেন (২৬), জাহাঙ্গীর হোসেন (৫৫), মেশিন মেইনটেন্যান্স সালাউদ্দিন (৩৫), মেশিন অপারেটর আবদুল খালেক খলিফা (৩৫), সিনিয়র অপারেটর জিনারুল ইসলাম মোল্লা (৩২), শ্রমিক ইমরান (১৮), সুজন (১৯),  আলম (২৫), ওমর ফারুক (৩২), রায়হান বিশ্বাস (১৬), ফয়সাল (২৯), মেহেদী হোসেন (২০) ও মাহাবুব হোসেন (২৫)। গতকাল শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে গিয়ে দেখা যায়, দগ্ধদের স্বজনরা আইসিইউয়ের সামনে অপেক্ষা করছেন। যখনই আইসিইউয়ের দরজা খোলা হচ্ছে তখনই আঁতকে উঠছেন তারা। নিজেদের রোগীর সর্বশেষ অবস্থা জানতে ছুটে যাচ্ছেন সেখানকার দায়িত্বরত নার্সের কাছে। পুরো করিডোরজুড়েই স্বজনদের অপেক্ষা। আবার কেউ একপাশে নির্জন জায়গায় গিয়ে বসে আহাজারি করছেন, কেউ আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছেন। আইসিইউয়ের দরজার পাশেই একটা অন্ধকার ছোট ঘর আছে। সেখানে অপেক্ষমাণ আছেন কিছু স্বজন। রোগীর  স্বজনের চোখে-মুখে আতঙ্কের ছাপ।  আইসিইউয়ের পাশেই বসে আহাজারি করছিলেন মারাত্মক দগ্ধ সোহানের (১৯) মা আফরোজা বেগম। আহাজারি করছেন, কাঁদছেন, আবার কিছুক্ষণ দুই হাত তুলে দোয়া করছেন সন্তানের জন্য। দুই পাশে থাকা তার দুই ছেলে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। সোহানের বাড়ি জামালপুরের মেলান্দহ উপজেলায়। ৮ হাজার টাকার বেতনে গত ৩ ডিসেম্বর ওই কারখানায় চাকরি নেয় সে। তারা ৪ ভাই-বোন। স্থানীয় একটি কলেজে এইচএসসি প্রথমবর্ষের পরীক্ষা দিয়েই সে ঢাকায় এসে কাজ নেয়। তার বড় ভাই আলমাস এ প্রতিবেদককে জানান, তিনি কৃষিকাজের পাশাপাশি রিকশাও চালান। তার ছোট ভাইয়ের বুক থেকে মুখ পর্যন্ত কিছুই চেনা যায় না। আগুনে পোড়ার খবর পেয়ে তারা হাসপাতালে ছুটে আসেন। এসে অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তারা সোহানকে পাচ্ছিলেন না। হাসপাতালে আসার পর সে তার ব্যান্ডেজ করা বাম হাতটি নাড়ায়। পরে তারা বলতে থাকেন কই সোহান, সোহান কই। তার এই কণ্ঠ শুনেই সোহান তাকে  চেনে। তখন তাকে নানা বলে ডাক দেয়। বলে- ‘নানা ভাই এই যে আমি সোহান, তুমি আমারে চিন না’। এই পর্যন্তই কথা হইছে আর কথা হয়নি। শুক্রবার থেকে আর কথা নাই, শুধু একবার চোখ মিটমিট করে খুলে দেখছে। এরপর থেকে তার আর জ্ঞান ফেরেনি।

আইসিইউর দরজার সামনে কথা হয় অপেক্ষমাণ সাহাজুলের বাবা নজরুলের সঙ্গে। তিনি ঢাকায় অটোরিকশা চালান। তাদের গ্রামের বাড়ি কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরীতে। এ প্রতিবেদককে বলেন, সাহাজুল নবম শ্রেণিতে পড়াশোনা করত। পড়াশোনার পাশাপাশি কারখানায় অপারেটর হিসেবে কাজ করত। তার বেতন ছিল ১২ হাজার টাকা। সে ৪ বছর ধরে ওই কারখানায়। নদীভাঙনে তাদের বাড়িঘর বিলীন হওয়ায় তারা সপরিবারে ঢাকায়  আসেন। তখন তিনি রিকশা নিয়ে বের হচ্ছিলেন, ওই সময় মোবাইলফোনে সাহাজুল তাকে বলে- ‘আব্বা আগুনে আমি পুড়েছি, তাড়াতাড়ি ঢাকা মেডিকেলে আসেন’। চিকিৎসকরা বলছেন, তার ৭০ শতাংশ পুড়েছে। তার মুখম-ল চেনার কোনো উপায় নেই।  বুধবার বিকালে কেরানীগঞ্জে প্রাইম প্লেট অ্যান্ড প্লাস্টিক কারখানায় আগুনের ঘটনা ঘটে। এ সময় ঘটনাস্থলে একজন নিহত হন। দগ্ধ হন অন্তত ৩২ জন। এদের মধ্যে ৩১ জনকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় ঢামেকে ভর্তি করা হয়।

সর্বশেষ খবর