সোমবার, ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা
নদীর কান্না

পানিশূন্য তিস্তায় সেচ বঞ্চনা

রেজাউল করিম মানিক, রংপুর

পানিশূন্য তিস্তায় সেচ বঞ্চনা

তিস্তা এখন ধু-ধু বালুচর -বাংলাদেশ প্রতিদিন

তিস্তা নদীতে পর্যাপ্ত পানি নেই। সেচ-সুবিধা পাচ্ছে না তিস্তা ব্যারাজ সেচ প্রকল্পের ৫২ হাজার হেক্টর জমি। এসব জমিতে বোরো ধান চাষ করতে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় সেচ দিতে হবে কৃষককে। এতে তাদের বাড়তি খরচ হবে ৭৭ কোটি টাকার বেশি। সেচ প্রকল্প সূত্র জানিয়েছেন, গত বছর ২৯ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও পানি সরবরাহ করা হয়েছে ৪০ হাজার হেক্টরে। এর পরও ৪৩ হাজার হেক্টর জমি সেচ-সুবিধার বাইরে ছিল।

২০১৪ সালে বোরো মৌসুমে লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর ও দিনাজপুর জেলার ৮৪ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ছিল। কিন্তু সেচ দেওয়া হয় মাত্র ১৮ হাজার হেক্টর জমিতে। ২০১৫ ও ২০১৬ সালে সেচ দেওয়া হয় ১০ হাজার হেক্টর জমিতে। ২০১৭ সালে মাত্র ৮ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দেওয়া হয়েছে। ২০১৯ সালে তা বেড়ে ৪০ হাজার হেক্টরে দাঁড়িয়েছিল। জানা গেছে, প্রথম দিকে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে চাষাবাদ শুরু করলেও পানির অভাবে প্রতি বছর সেচের জমি কমে যায়। নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় সেচ দিলে হেক্টরপ্রতি কৃষকের বাড়তি খরচ হচ্ছে ১৫ থেকে ১৭ হাজার টাকা। সে হিসাবে ৫২ হাজার হেক্টরে কৃষকের বাড়তি খরচ পড়বে ৭৭ কোটি টাকার বেশি। তিস্তা ব্যারাজ সেচ প্রকল্প সম্প্রসারণ কর্মকর্তা রাফিউল বারী জানান, চলতি রবি ও খরিপ-১ মৌসুমে ২৫ জানুয়ারি সেচ দেওয়া শুরু হয়। শুরুতে সেচ দেওয়া হয় জলঢাকা উপজেলায়। পরে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী সেচ দেওয়ার চেষ্টা করা হবে। তিনি বলেন, উজানে পানিপ্রবাহ দিন দিন কমায় তিস্তা শুকিয়ে যাচ্ছে। ফলে তিস্তা ব্যারাজের কমান্ড এলাকায় সম্পূরক সেচ কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব হচ্ছে না। এবার এসব এলাকায় কৃষকের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় সেচ দিতে হবে। তিনি জানান, শুষ্ক মৌসুমে তিস্তার পানিপ্রবাহ রেকর্ড পরিমাণ কমেছে। নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ ধরে রাখতে তিস্তা ব্যারাজের সেচ প্রকল্পের জন্য ১০ হাজার কিউসেক পানি প্রয়োজন। কিন্তু সেচের জন্য পাওয়া যাচ্ছে ৭০০ থেকে ৮০০ কিউসেক। গত বছর লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি জমিতে সেচ দেওয়া হয়েছিল। এবারও লক্ষ্যমাত্রার বেশি সেচ দেওয়া যাবে বলে আশা করছেন তিনি। জানা গেছে, তিস্তা অববাহিকার ৫ হাজার ৪২৭টি গ্রামের মানুষের জীবিকা এ নদীর ওপর নির্ভরশীল। তিস্তায় পানিপ্রবাহ কমে যাওয়ায় এখানকার মানুষের জীবনে নেমে এসেছে চরম অনিশ্চয়তা। তিস্তা অববাহিকার ৮ হাজার ৫১ বর্গকিলোমিটার এলাকা ভারতের পাহাড়ি অঞ্চল। সমতল ভূমিতে তিস্তা অববাহিকা ৪ হাজার ১০৮ বর্গকিলোমিটার। তার প্রায় অর্ধেক অংশ পড়েছে বাংলাদেশের সীমানায়। দুই দেশই তিস্তার পানির সর্বোচ্চ ব্যবহারের জন্য বিভিন্ন সময়ে নদীর ওপর ও আশপাশে ব্যাপক অবকাঠামো তৈরি করেছে। ভারত জলবিদ্যুৎ উৎপাদন ও সেচ কার্যক্রমের জন্য তিস্তার পানি ব্যবহার করছে। বাংলাদেশ তিস্তার পানি ব্যবহার করছে শুধু পরিকল্পিত সেচ দেওয়ার কাজে। কিন্তু গত এক দশকের বেশি সময় ধরে শুষ্ক মৌসুমে ভারতের একচেটিয়া পানি প্রত্যাহারের কারণে বাংলাদেশ অংশে তিস্তার পানি ক্রমাগত কমছে। তিস্তার পানির ওপর নির্ভরশীল উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের লালমনিরহাট জেলার হাতীবান্ধা; নীলফামারীর সদর, ডিমলা, জলঢাকা, কিশোরগঞ্জ, সৈয়দপুর; রংপুরের সদর, তারাগঞ্জ, বদরগঞ্জ, গঙ্গাচড়া; দিনাজপুরের পার্বতীপুর, চিরিরবন্দর, খানসামা প্রভৃতি তিস্তা সেচ প্রকল্পের আওতায় ছিল। কিন্তু পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় এসব উপজেলায় সেচ দেওয়া যাচ্ছে না। সূত্র জানান, ভারত ৬৮ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র ও ৫ লাখ ৪০ হাজার হেক্টর জমির সেচের চাহিদা মিটিয়ে যে পরিমাণ পানি ছাড়ে, তা দিয়ে বোরো মৌসুমে বাংলাদেশের সেচ চাহিদার অর্ধেকও পূরণ হয় না। ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশে শুষ্ক মৌসুমে তিস্তায় পানিপ্রবাহ ছিল প্রায় ৬ হাজার ৫০০ কিউসেক। তা ২০০৬ সালে নেমে আসে ১ হাজার ৩৪৮ কিউসেকে। ২০১৯ সালে পানিপ্রবাহ ছিল মাত্র ৭০০ কিউসেক। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে পানি পাওয়া যাচ্ছে ১ হাজার ৩০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ কিউসেক। শুকনো মৌসুমে ভারতের পানি প্রত্যাহারের পর তিস্তায় যে সামান্য পানি পাওয়া যায়, তার সবটুকুই সেচ চাহিদা মেটানোর লক্ষ্যে তিস্তা ব্যারাজ প্রকল্পের সেচ খালের মাধ্যমে কৃষিজমিতে সরবরাহ করা হচ্ছে। এর ফলে ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তা ব্যারাজের পর থেকে ৯৭ কিলোমিটার বিস্তৃত তিস্তা নদীতে পানিও থাকছে না। এ কারণে তিস্তা অববাহিকার বাংলাদেশ অংশের এ বিশাল পরিমাণ নদীগর্ভ পরিণত হচ্ছে বালুচরে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর