শুক্রবার, ২২ মে, ২০২০ ০০:০০ টা

করোনা ও আম্ফানে ত্রিমুখী সংকটে চট্টগ্রাম বন্দর

ফারুক তাহের, চট্টগ্রাম

করোনার দীর্ঘমেয়াদি ধাক্কা, ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের চাপ ও আসন্ন ঈদের ছুটি- সব মিলিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর এখন এক কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। ফলে দিন দিন কনটেইনার ও জাহাজ জটের মাত্রা বেড়ে চলেছে। এর প্রভাব গিয়ে পড়ছে দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য থেকে সামগ্রিক অর্থনীতিতে। কঠিন এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ইতিপূর্বে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় ও বন্দর কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করলেও চ্যালেঞ্জের ফাঁড়া যেন কাটছেই না। একের পর এক সংকটের মধ্য দিয়েই যাচ্ছে বন্দরের সার্বিক কার্যক্রম- এমনটি মনে করছেন বন্দরসংশ্লিষ্টরা।

এদিকে সুপার সাইক্লোন আম্ফানের প্রভাবে টানা দুই দিন বন্দরের কনটেইনার হ্যান্ডলিং ও পণ্য ওঠানো-নামানোর কাজ বন্ধ থাকার পর পুনরায় চালু হতে শুরু করেছে। ঘূর্ণিঝড় আম্ফান দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উপকূল অতিক্রমের পর আবহাওয়া অফিস সতর্কসংকেত ৩ নম্বরে নামিয়ে আনায় ক্রমে সচল হচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দর। বৃহস্পতিবার বেলা ১১টার মধ্যে বহির্নোঙর থেকে একটি কনটেইনার জাহাজ টাগবোটের সাহায্যে জেটিতে নিয়ে আসেন বন্দরের পাইলটরা। এরপর বেলা ২টার  দিকে মোট সাতটি কনটেইনারবাহী জাহাজ পণ্য খালাসের জন্য বিভিন্ন জেটিতে আনা হয় বলে জানান বন্দর সচিব মো. ওমর ফারুক। এর মধ্যে তিনটিতে পণ্য খালাসের কাজও শুরু হয়েছে। ৪৯ হাজার টিইইউস কনটেইনার ধারণক্ষমতাসম্পন্ন চট্টগ্রাম বন্দরে গতকাল পর্যন্ত কনটেইনার ছিল প্রায় ৪৫ হাজার টিইইউস। এর মধ্যে নতুন করে বার্থিং নিয়েছে আরও সাতটি কনটেইনারবাহী জাহাজ। ঘূর্ণিঝড়ের আগে বন্দরের বহির্নোঙরে ছিল ৪০টি এবং বার্থিংয়ে ছিল ১২টি কনটেইনারবাহী জাহাজ। এসব জাহাজের কনটেইনার খালাস কার্যক্রম বর্তমান পরিস্থিতিতে অনেকটা অসম্ভব বলেই জানান বন্দর ব্যবহারকারীরা। যদি বন্দর ইয়ার্ড থেকে পুরনো কনটেইনার ডেলিভারি না হয়, তাহলে এতগুলো কনটেইনারবাহী জাহাজের মালামাল খালাস করার কোনো সুযোগ হবে না বলে জানান তারা। সূত্র জানান, করোনা সংক্রমণের কারণে দেশব্যাপী সাধরাণ ছুটি ও লকডাউন পরিস্থিতিতে মার্চের শুরু থেকে বন্দরে দেখা দেয় ভয়াবহ কনটেইনার-জট। এপ্রিলে কনটেইনারের সঙ্গে যুক্ত হয় জাহাজ-জটও। এ অবস্থায় কনটেইনারের স্টোর রেন্ট শতভাগ মওকুফ এবং অফ ডকে সব ধরনের আমদানি পণ্যের কনটেইনার খালাসের সুযোগ দিয়ে উদ্ভূত পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার দ্রুত ব্যবস্থা নেয় কর্তৃপক্ষ। এতে জাহাজ ও কনটেইনার জট কিছুটা কমেও এসেছিল। কিন্তু যত-সংখ্যক কনটেইনার ডেলিভারি হবে বলে সংশ্লিষ্টরা প্রত্যাশা করেছিলেন, সে অনুপাতে কনটেইনার ডেলিভারি হয়নি। এর ওপর মঙ্গলবার থেকে ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের কারণে বন্দরে কার্যক্রম সম্পূর্ণই বন্ধ ছিল। জেটি থেকে সব ধরনের জাহাজকে নিরাপদে সরিয়ে জাহাজশূন্য করা হয় বন্দরের জেটিগুলো। আবার চলতি মে’র দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে আমদানির পরিমাণ কিছুটা বেড়ে যাওয়ায় কনটেইনারের চাপও বাড়তে থাকে। এ অবস্থায় গত তিন দিন টানা বন্দর প্রায় বন্ধ ছিল। এ ছাড়া অত্যাসন্ন ঈদের ছুটির কারণে কনটেইনার ডেলিভারিতে শ্লথগতি শুরু হওয়ায় ত্রিমুখী চাপে পড়েছে চট্টগ্রাম বন্দর।

বন্দর সচিব মো. ওমর ফারুক বলেন, ‘আবহাওয়া অফিস সতর্কসংকেত কমিয়ে দেওয়ায় বন্দরের নিজস্ব অ্যালার্ট তুলে নেওয়া হয়েছে। ফলে বন্দরের স্বাভাবিক কার্যক্রম শুরু হয়েছে। তবে প্রাকৃতিকভাবে ঘূর্ণিঝড় ও ঈদের ছুটির প্রভাবে কিছুটা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে আমাদের। ঈদের ছুটিতেও কনটেইনার ডেলিভারির কাজ পুরোদমে চালু থাকে। তাই সংশ্লিষ্ট আমদানিকারকদের আমরা জানিয়েছি, এ সময় যেন তারা কনটেইনার ডেলিভারি অব্যাহত রাখেন।’

এদিকে করোনা পরিস্থিতির কারণে মার্চ থেকে টানা প্রায় দেড় মাস থমকে ছিল চট্টগ্রাম বন্দর। এ সময় কনটেইনার আর জাহাজ জটে পড়ে দেশের এই প্রধান বন্দর। তবে কনটেইনার জট কমানোর জন্য নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ তিন দফায় ১৬ মের সাধারণ ছুটি পর্যন্ত সব ধরনের কনটেইনারের স্টোর রেন্ট শতভাগ মওকুফ করে। এতে কনটেইনার ডেলিভারিতে গতি ফিরে আসে। বিজিএমইএসহ দেশের প্রধান ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এ সুযোগ তৃতীয়বারের মতো ১৬ মে সাধারণ ছুটি পর্যন্ত বাড়ানো হয়। কিন্তু সাধারণ ছুটি ৩১ মে পর্যন্ত বাড়ানো হলেও কনটেইনারের স্টোর রেন্টের মেয়াদ আর বাড়ানো হয়নি।

বন্দরসূত্রে জানা গেছে, কনটেইনার ও জাহাজ জট কমাতে ব্যবসায়ীদের বন্দর স্টোর চার্জ বাবদ মওকুফ করতে হয়েছে প্রায় ২০০ কোটি টাকা। এ ছাড়া অফ ডকে সব ধরনের কনটেইনার ডেলিভারির সুযোগসহ আরও অনেক পদক্ষেপ নিতে হয়েছে। দেড় মাসের বেশি সময় ধরে স্টোর রেন্ট মওকুফের সুযোগ পেয়েও অনেকে তা কাজে লাগাতে পারেনি। অন্যদিকে সৃষ্ট জাহাজ-জটের কারণে একেকটি জাহাজকে এক দিনের জন্য তাদের খরচ বহন করতে হয় ন্যূনতম ১০ হাজার ডলার। একটি জাহাজকে বন্দরে বার্থিং নিতে এবং পণ্য খালাসের জন্য যদি অতিরিক্ত পাঁচ দিন বসে থাকতে হয়, তাহলে তাদের ৫০ হাজার ডলার অতিরিক্ত ব্যয় নির্বাহ করতে হয়। আর এর প্রভাব সরাসরি পড়ে আমদানি করা পণ্যে এবং দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে। এ কারণে পণ্যের দাম বেড়ে যায় এবং শেষ পর্যন্ত তা দেশের সাধারণ ভোক্তাশ্রেণির ঘাড়েই পড়ে।

সর্বশেষ খবর