মঙ্গলবার, ২ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

মাটিচাপা দিলেও গুম হয়নি লাশ

মির্জা মেহেদী তমাল

মাটিচাপা দিলেও গুম হয়নি লাশ

গাজীপুরের কাপাসিয়ার একটি গ্রাম আড়াল বাজার। হরেক রকমের গাছ এ গ্রামকে সবুজ শীতল করে রাখে। পাখপাখালি আর গাছগাছালিতে ছাওয়া গ্রামটি গ্রামবাসীর কাছে শান্তির এক নীড় হলেও শান্তি ছিল না ষাটোর্ধ্ব সুফিয়া বেগমের ঘরে। কখনো সন্ধ্যায়, কখনো দিনের বেলায় আবার কখনো মধ্যরাতে সুফিয়া বেগমের আহাজারি শোনা যায়। তখন হৃদয়বিদারক পরিবেশের সৃষ্টি হয়। প্রায় প্রতিদিনই বাড়ির দরজায় বসে পথের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন তিনি। হঠাৎ হঠাৎ ছোট মেয়ে আনজুমকে ডেকে বলেন, ‘মা রে! ফোন দিছস শিখারে। কবে আইব? কী কয় শিখা?’ মায়ের এমন আকুতিতে আনজুম ফোনে চেষ্টা করে বড় বোন শিখাকে পাওয়ার। কিন্তু শিখার ফোন সুইচ অফ পায়। ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না শুনে মায়ের মন খারাপ হয়। হাউমাউ করে কাঁদতে থাকেন। শিখা মণি। সুফিয়া বেগমের বড় মেয়ে। শিখা তার স্বামীকে নিয়ে শ্রীপুরে ভাড়া বাসায় থাকেন। স্বামী একসময় দুবাই যান। বিদেশে যাওয়া-আসার মধ্যে ছিলেন স্বামী। সংসার ভালোই চলছিল। মা সুফিয়া বেগম ও বোন আনজুমের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ হতো। প্রয়োজন হলে মা-বোনের টাকা পাঠাত। স্বামী বিদেশ থাকায় মা তাকে নিজের কাছে আনতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শিখা রাজি হননি। হঠাৎই শিখার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। শিখার ফোনে বারবার কল দিলেও সুইচ বন্ধ পাওয়া যায়। খোঁজ নিয়েও শিখার খোঁজ পাচ্ছিলেন না। তারা শ্রীপুরে খোঁজ নেন। জানতে পারেন, তাদের শিখা এক সন্ধ্যায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান। আর ফেরেননি। অজানা আশঙ্কায় মা-বোনের বুক কাঁপে। তাদের ধারণা, কোথাও হয়তো গেছেন। আসবেন ফিরে। এমন সান্ত্বনা নিয়ে বাড়ি ফেরেন। ঘটনাটি ২০১৮ সালের। ২৮ নভেম্বর থেকে শিখা নিখোঁজ। দিন যায়, সপ্তাহ পার হয় শিখা নেই।

নিখোঁজের ২১ দিন পর সুফিয়া বেগম গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের (জিএমপি) সদর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। তাতে শিখার শারীরিক বর্ণনা দেন বয়স আনুমানিক ২২ বছর। গায়ের রং শ্যামলা। উচ্চতা ৫ ফুট ৩ ইঞ্চি। পরনে ছিল সালোয়ার-কামিজ। এদিকে শিখা নিখোঁজের ১৬ দিন পর ২০১৮ সালের ১৩ ডিসেম্বর শ্রীপুরের পোড়াবাড়ী পূর্বপাড়া, কোনাপাড়ার একটি পুকুরের উত্তর-পূর্ব কোণে কাদার মধ্যে মাথা খানিকটা বের করা অবস্থায় একটি মৃতদেহের সন্ধান পান স্থানীয়রা। সংবাদ দেওয়া হয় পুলিশকে। সদর থানার পুলিশ এসে মাটি খুঁড়ে লাশটি উদ্ধার করে। পুলিশের সুরতহাল রিপোর্টে লাশটি আনুমানিক ৩২ বছর বয়সী একজন নারীর উল্লেখ করা হয়। স্থানীয় অনেকেই দেখলেও মৃতদেহটি শনাক্ত করতে পারেননি। কেননা লাশের পরনে কোনো কাপড় ছিল না। এমনকি পুরো শরীর ছিল চামড়াবিহীন ও ফোলা। পুলিশ ও স্থানীয়দের ধারণা, জঙ্গলের শেয়াল টেনে বের না করলে নির্জন এ জায়গায় কাউকে পুঁতে রাখার খবর কোনো দিন জানা যেত না। অজ্ঞাতনামা ওই মহিলাকে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে বলে ময়নাতদন্ত রিপোর্টে চিকিৎসক উল্লেখ করেন। হত্যা মামলা করেন গাজীপুর সদর থানার এসআই মোহাম্মদ মাহাবুব। সদর থানার এসআই জহির মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পান। তদন্তের একপর্যায়ে পুলিশ জানতে পারে এক রাতে পুকুরপাড়ে আলমগীর নামে এক যুবককে দেখা গেছে। পুলিশ দেরি করেনি। আলমগীরকে গ্রেফতার করে ওই এলাকা থেকেই। জেরা শুরু করে। বেশিক্ষণ লাগেনি। আলমগীর স্বীকার করেন লাশটি মাটির নিচে পুঁতে রাখার সময় তিনিও ছিলেন। তার চাচা মোকসেদের প্রেমিকা এই নারী। তবে প্রেমিকার নাম-ঠিকানা কিছুই বলতে পারেননি আলমগীর। পুলিশ ঘটনার সূত্র পেলেও লাশের পরিচয় আর পায় না। গ্রেফতার করতে পারে না মোকসেদকে। ইতিমধ্যে পুলিশ জানতে পারে একটি নিখোঁজের জিডি হয়েছে সদর থানায়। সেই সূত্র ধরে পুলিশ সুফিয়া বেগমকে ডেকে নিয়ে আসে। লাশের ছবি দেখায়। চিনতে পারেন না লাশের চেহারা দেখে। তারা ফিরে যান। এভাবেই কেটে যায় দুই বছর। সুফিয়া বেগম তার মেয়ের সন্ধান করতে গিয়ে পাগলপ্রায়। ওদিকে পরিচয় মেলেনি অজ্ঞাত ওই নারীর। গ্রেফতারও হলো না মোকসেদ। এ অবস্থায় মামলা তদন্তের দায়িত্ব আসে গাজীপুর জেলা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন- পিবিআইর কাছে। নাটকীয় মোড় নেয় পুরো ঘটনা। পিবিআইর তদন্ত কর্মকর্তা চিন্তা করেন দুই বছর পর মোকসেদকে গ্রেফতার করা কঠিন হলেও গ্রেফতার ছাড়া কোনো উপায় নেই। এ ছাড়া লাশের পরিচয়ও বের করতে হবে। নতুবা রহস্য উন্মোচন হবে না।

দায়িত্ব পাওয়ার পর গোয়েন্দা তৎপরতার একপর্যায়ে পিবিআই জানতে পারে চট্টগ্রামের আগ্রাবাদে অবস্থান করছেন মোকসেদ। জামিনের চেষ্টা করছেন সেখান থেকে। মোকসেদের আদালতে যাওয়ার আগের দিন তাকে ধরতে অভিযানে নামে পিবিআই। মোকসেদের কাছে পৌঁছাতে প্রথমে তার এক পরিচিত ব্যক্তিকে আটকের সিদ্ধান্ত নেয় পিবিআই। অনেক খোঁজাখুঁজির পর মেলে তার সন্ধান। ওই ব্যক্তি থেকে জানা যায় তৃতীয় স্ত্রীর সঙ্গে বাসন থানার শাহ আলম বাড়ী এলাকায় এমদাদের বাড়িতে ‘মামুন’ ছদ্মনামে থাকেন মোকসেদ। পিবিআইর অভিযানে অজ্ঞাত নারীর লাশ উদ্ধারের দুই বছর পর গ্রেফতার হন মোকসেদ আলী। মোকসেদ আলী স্বীকার করতে থাকেন পুরো ঘটনা। অজ্ঞাত নারীর লাশের খবর বের করতে গিয়ে পিবিআই একই সঙ্গে নিখোঁজ শিখা মণির খবর পেয়ে যায়।

পুলিশ জানতে পারে মোকসেদ গরুর দুধ বিক্রি করতেন। দুবাইপ্রবাসীর স্ত্রী শিখা মণির বাসায় দুধ বিক্রির সময় দুজনের পরিচয় বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কে গড়ায়। তারা দুজনই একজন আরেকজনের বাড়িতে নিয়মিত আসা-যাওয়া করতেন। একপর্যায়ে গরু কেনার জন্য টাকা চাইলে শিখা মণি স্বামীর পাঠানো টাকা থেকে দেড় লাখ ধার দেন মোকসেদকে। শিখা ধার দেওয়া টাকা ফেরত চাইলে দুজনের মধ্যে মনোমালিন্য হয়। সন্ধ্যা ৬টার দিকে দেখা করার কথা বলে শিখাকে হাজারিবাগান পেরিয়ে গজারিবনে নিয়ে যান মোকসেদ। কথা বলার একপর্যায়ে ওড়না পেঁচিয়ে শিখাকে শ্বাসরোধে হত্যা করেন। এরপর রাত ১১টার দিকে ভাই মজিবর, ভাতিজা আলমগীর ও জাহাঙ্গীরকে ডেকে নিয়ে আসেন। কোনোভাবেই যেন পরিচয় জানা না যায় তা নিশ্চিত করতে শিখা মণির জামাকাপড় খুলে তাকে বিবস্ত্র অবস্থায় মাটিচাপা দেন তারা। অপরাধের চিহ্ন মুছে ফেলতে শিখার গা থেকে খুলে নেওয়া কাপড়-চোপড় নিজের বাড়িতে নিয়ে পুড়িয়ে ফেলেন মোকসেদ। আর শিখার মোবাইল ফোনটি পাশের ডোবায় ফেলে দেন। ঘরে কোদাল রেখে গা ঢাকা দেন। জেরার একপর্যায়ে মোকসেদ জানান, শিখার গ্রামের বাড়ি কাপাসিয়ার আড়াল বাজার। পিবিআই তখনো জানে না আড়াল বাজারের সুফিয়া বেগম তার মেয়ে শিখা মণি নিখোঁজ জানিয়ে থানায় জিডি করেছেন। সুফিয়া বেগমকে ডেকে এনে শিখার লাশের ছবি দেখায় পিবিআই। জানায় মোকসেদের দেওয়া বিবরণও।

অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খুনি যেখানেই লুকিয়ে থাকুক পুলিশ সঠিকভাবে কাজ করলে সন্ধান পাবেই।

সর্বশেষ খবর