সৌন্দর্য বর্ধন, নান্দনিকতা এবং ইতিহাস-ঐতিহ্যের স্মারক হিসেবে রাজধানীর প্রধান সড়কগুলোতে বিভিন্ন সময় স্থাপন করা হয়েছে দৃষ্টিনন্দন ফোয়ারা। বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী ফোয়ারা দিয়ে পানি প্রবাহিত হওয়ার কথা থাকলেও অনেক ফোয়ারায় নেই কোনো পানির প্রবাহ। প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে অযত্ন-অবহেলায় পড়ে আছে এসব ফোয়ারা। নিয়মিত পরিচর্যা না থাকায় ফোয়ারাগুলো ধুলাবালিতে ঢাকা পড়ে বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে। ফোয়ারার আশপাশে জমেছে আবর্জনার স্তূপ। বিজয় সরণি মোড়ের ফোয়ারাটির নাম ‘বিজয় সরণি ফোয়ারা’। তার দেয়ালে আবহমান গ্রামবাংলার ঐহিত্য অঙ্কিত। আছে বাংলাদেশের বিজয় এবং ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসও। এতে তুলে ধরা হয়েছে একাত্তরের ভয়াল দিনগুলোর ইতিহাস। আশির দশকের শেষদিকে ফোয়ারাটি নির্মিত হয়। লাল-সবুজের এই ফোয়ারার নকশা করেন শিল্পী জি এম রাজ্জাক। ফোয়ারার চারপাশে ম্যুরালের নকশা করেন শিল্পী সৈয়দ লুৎফুল হক। ম্যুরালের কাজ করেন ভাস্কর মুকসুদ্দীন ও হিমাংশু। একসময় এই ফোয়ারাটির ওপর সাতটি লাল স্তম্ভ দেশের সাতজন বীরশ্রেষ্ঠের প্রতীকী উপস্থিতির জানান দিত। স্তম্ভগুলো এখন আর নেই। রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ এই স্থাপনাটির এখন বেহাল দশা। দীর্ঘদিন ধরেই অযত্ন-অবহেলা ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ফোয়ারাটি এখন জীর্ণশীর্ণ। দীর্ঘদিন ধরে এই ফোয়ারায় পানি নেই। জলাধারের স্থানে ময়লা-দুর্গন্ধযুক্ত পানি। ময়লা পানিতে ভেসে আছে প্লাস্টিক, কর্কশিট, ছেঁড়া কাগজসহ ময়লা-আবর্জনা। এর মধ্যে জন্ম নিচ্ছে মশার লার্ভা। ফোয়ারাটির ম্যুরাল যে টাইলস দিয়ে বানানো তা স্থানে স্থানে ভেঙে গেছে। কতক উঠেও গেছে। ফোয়ারাটির চারপাশের ইটের গাঁথুনিও স্থানে স্থানে ভেঙে গেছে। সৌন্দর্য বর্ধনের বদলে এই ফোয়ারাটি উল্টো শহরের সৌন্দর্য নষ্ট করছে। এই ফোয়রাটির পানির প্রবাহ কতদিন ধরে চালু হয় না তার কোনো হিসাব নেই। ফোয়ারার পাইপের ওপরের অংশে যে তার দিয়ে পানি ওপরে ওঠে তা উধাও। বিভিন্ন স্টিকার ও ব্যানারেই বছরের অধিকাংশ সময় এই ফোয়ারাটি ঢেকে থাকে। কারওয়ান বাজারে সোনারগাঁও হোটেলের সামনে অবস্থিত ‘সার্ক ফোয়ারা’। একসময় ফোয়ারাটিতে পানির ধারা প্রবাহিত হলেও এটি কতদিন যে পানিবিহীন তার কোনো হিসাব নেই। দৃষ্টিনন্দন এই ফোয়ারার মনোমুগ্ধকর দৃশ্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন শহরবাসী। দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা-সার্কের অন্যতম সদস্য বাংলাদেশের রাজধানীতে ১৯৯৩ সালে এটি নির্মিত হয়। এর নকশা করেন নিতুন কুন্ডু। এর জলাধারও ময়লা-আবর্জনায় পরিপূর্ণ। স্টিলের তৈরি এই ফোয়ারার বেদিতে ২০১৭ সালে একটি ট্রাক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ধাক্কা দেয়। এতে এর একটি অংশ ভেঙে যায়। মতিঝিল ব্যাংকপাড়ায় রয়েছে ‘শাপলা চত্বর ফোয়ারা’। বিশালাকার শাপলা ফুলের ভাস্কর্য একটি ঝরনা দ্বারা বেষ্টিত হওয়ায় এটি শাপলা চত্বর নামে পরিচিত। গুরুত্বপূর্ণ কোনো দিবস ছাড়া এই ফোয়ারায় পানি দেখা যায় না। ঢাকার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ফোয়ারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার ‘দোয়েল চত্বর ফোয়ারা’। এর স্থপতি আজিজুল জলিল পাশা। এই ফোয়ারাটিও দেশের জাতীয় বৈশিষ্ট্যের ধারক ও বাহক। ১৯৭৪ সালে রাষ্ট্রায়ত্ত উত্তরা ব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় তৈরি হয়েছে জোড়া দোয়েলের এই ভাস্কর্য। দীর্ঘদিনের অযত্ন-অবহেলায় এই ফোয়ারাটিরও সৌন্দর্যহানি ঘটে। ২০১৬ সালে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের তত্ত্বাবধানে এর সংস্কার কাজ হয়। তখন আধুনিক লাইটিং ব্যবস্থাসহ ১২০টি ট্যাপের পানি দিয়ে ফোয়ারা লাগানো হয়। কিন্তু এরপর নিয়মিত এই ফোয়ারায় পানি প্রবাহিত না হলেও মাঝে মধ্যে পানি প্রবাহ হতে দেখেন পথচারীরা। নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে সংস্কৃতি ধরে রাখার যে ইচ্ছা, তার অভাব বোধের কারণেই শহরের ফোয়ারাগুলোর এই বেহাল দশা। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এ বি এম আমিন উল্লাহ নূরী বলেন, শহরের ফোয়ারাগুলো নতুন আঙ্গিকে সংস্কার করার জন্য আমরা একটি মাস্টার প্ল্যান নিয়েছি। এটি বাস্তবায়নে কিছুটা সময় লাগবে। তিনি বলেন, বিভিন্ন সময় দক্ষিণের ফোয়ারাগুলো সংস্কার করা হলেও প্রয়োজনীয় জনবলের অভাবে এতে নিয়মিত পানি প্রবাহের ব্যবস্থা করা কষ্টকর হয়ে পড়ে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মুহ. আমিনুল ইসলাম বলেন, ফোয়ারার রক্ষণাবেক্ষণের বিষয়টি আমরা উত্তরের মেয়র মো. আতিকুল ইসলামকে জানাব। এরপর তিনি করণীয় ঠিক করবেন।