শুক্রবার, ৯ এপ্রিল, ২০২১ ০০:০০ টা

কান্না ছিল পথের কাঁটা

মির্জা মেহেদী তমাল

কান্না ছিল পথের কাঁটা

বছর দেড়েকের নাম-পরিচয়হীন শিশুর লাশ। একটি চেক লুঙ্গি দিয়ে পেঁচানো ছিল। ফতুল্লার পাগলায় দুটি বিল্ডিংয়ের মাঝখানে ছোট্ট নিথর দেহটি পড়ে ছিল। লোকমুখে শুনে পুলিশ লাশ উদ্ধার করে। শিশুটির পরিচয় জানতে পুলিশ নানা উদ্যোগ নেয়। এলাকায় মাইকিং করা হয়। মাইকিং শুনে এক মহিলা থানায় এসে হাজির। তিনি শিশুটির মুখ দেখেই আঁতকে ওঠেন। পুলিশকে বলেন, স্যার এ তো আমার বোন বিলকিসের মেয়ে মরিয়মের লাশ। কে মারল এমন করে? শুনে পুলিশ তার বোনের বাড়িতে ছুটে যায়। পাগলার একটি টিনশেড বাড়িতে তারা ভাড়া থাকত। কিন্তু বিলকিস এবং তার স্বামী সোলেমানকে পাওয়া গেল না। তাদের ঘরে তালা। পুলিশ আশঙ্কা করছে, তাদেরও কোনো বিপদ হলো কি না। মাত্র দুই দিন আগে বিলকিস ও তার স্বামী সোলেমান ওই বাড়িতে ভাড়াটিয়া হিসেবে উঠেছে। এরই মধ্যে তাদের শিশুসন্তান খুন আর তারাও লাপাত্তা! পুলিশ তদন্ত শুরু করে। ফতুল্লা থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়। কিন্তু ফতুল্লা থানা পুলিশ এর কোনো কিনারা করতে পারে না। মামলার তদন্তভার পড়ে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)-এর ওপর। পিবিআই নতুন করে তদন্ত শুরু করে। তারা বিলকিস বেগম এবং তার স্বামী সোলেমানের অবস্থান জানার চেষ্টা করে। অবশেষে বিলকিসকে পাওয়া যায় পটুয়াখালীতে আর সোলেমানকে ধরা হয় কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে। পুলিশ তাদের কাছ থেকে জানতে পারে এক পাষ- মা-বাবার খুনি হওয়ার কাহিনি। ২০ বছরের বিলকিস বেগম। পটুয়াখালীর গলাচিপা থানার ঝাটিয়া কলাকাইচ্ছা গ্রামের নয়া হালদারের মেয়ে। বাবা-মা থাকেন নারায়ণগঞ্জের পাগলায়। পেশায় শ্রমিক। মেয়েকে একই গ্রামের নাসিরের সঙ্গে বিয়ে দেন সুখের আশায়। নাসির কৃষিকাজ করেন।

বিলকিসদের একমাত্র মেয়ে মরিয়ম। কিন্তু নাসিরের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো যাচ্ছিল না বিলকিসের। কয়েক দিন বয়সী মরিয়মকে নিয়ে নারায়ণগঞ্জে বাবা-মার কাছে চলে আসে। বিভিন্ন বাড়ির গৃহকর্মে সহায়তার কাজ জুটিয়ে নেয়। এরই মধ্যে কেটে যায় কয়েক মাস। মোবাইলে হঠাৎ পরিচয় হয় মাদারগঞ্জের ঘরপাড়া গ্রামের সোলেমানের সঙ্গে। সোলেমান তখন ফরিদপুরে। যখন যে কাজ পাওয়া যায়, সেই কাজই তার পেশা হয়ে যায়। পরিচয় থেকে প্রেম-ভালোবাসা। কয়েক মাস পর সোলেমান দেখা করে বিলকিসের সঙ্গে। দেখে বিলকিস শুধু বিবাহিতই নয়, মরিয়ম নামে ছয় মাসের একটি কন্যাসন্তানও আছে। তাদের প্রেমে তখন বাঁধভাঙা জোয়ার, কিচ্ছু মানে না। দুজনে ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেয়। বিলকিস তার বাবা-মার অনুমতি নিয়ে তার স্বামী নাসিরকে ছেড়ে দেয়। সোলেমানের হাত ধরে নতুন জীবন গড়তে জামালপুরে চলে যায়। সোলেমানদের বাড়িতে পারিবারিকভাবে বিয়ে হয় তাদের। বিয়ের পর আবার তারা পাগলায় চলে আসে। কিছুদিন বাবা-মার সঙ্গে থেকে  নন্দলালপুর বায়তুল নূর জামে মসজিদ রোডে দ্বিতীয় তলার একটি টিনশেড কক্ষ ভাড়া নেয়। দুজনেই কাজে লেগে যায়। ছোট্ট শিশু মরিয়মের তখন দেড় বছর বয়স। সে জানলও না তার বাবা পরিবর্তন হয়ে গেছে। কান্না ছাড়া তার কিছু নেই। এ কান্নাই হয়ে গেল দাম্পত্যজীবনের পথের কাঁটা। হ্যাঁ, বিলকিস ও সোলেমান দুজনে আদালতে এ শব্দটাই ব্যবহার করেছে খুনের কারণ হিসেবে। দুজনে আলোচনা করেই ঠিক করে পথের কাঁটা উপড়ানোর সোজা পথ। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের হালকা শীতের রাতে মরিয়ম ঘুমিয়ে ছিল সোয়েটার গায়ে। সৎবাবার মাফলার দিয়ে মরিয়মের গলা পেঁচানো হয়। মাফলারের দুই মাথা ধরে টান দিলেই হলো। একটি ঘুমন্ত শিশুকে হত্যা করা তাদের যে কোনো একজনের পক্ষেই সম্ভব ছিল। কিন্তু  মরিয়ম তো দুজনেরই চক্ষুশূল। তাই তার গর্ভধারিণী মা ধরল মাফলারের এক অংশ এবং  অপর পাশ ধরে টানল তার  নতুন  বাবা। একটি চেক লুঙ্গি দিয়ে পেঁচিয়ে দুই বিল্ডিংয়ের মাঝখান দিয়ে ছোট্ট নিথর দেহটি ফেলে দেওয়া হয়। কেউ তাকে চেনে না। সবার অগোচরে মরিয়ম চলে গেল না ফেরার দেশে। খুনের পর পরই এ জঘন্য নরপিশাচরা ময়মনসিংহে চলে যায় ঝামেলাবিহীন নতুন সংসারের উদ্দেশ্যে। কিন্তু তারা জানতে পারে, পুলিশ তাদের খুঁজছে। এরপর বিলকিস যায় পটুয়াখালী। সোলেমান পালিয়ে বেড়াতে থাকে ঢাকায়। এর পরের ঘটনা সবার জানা। সূত্র : ফতুল্লা মডেল থানার মামলা নম্বর- ৫৬, ধারা-৩০২/২০১/৩৪ দঃ বিঃ। তারিখ ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর