মঙ্গলবার, ৪ মে, ২০২১ ০০:০০ টা

খুনের সাক্ষী ছিল বাকপ্রতিবন্ধী

মির্জা মেহেদী তমাল

খুনের সাক্ষী ছিল বাকপ্রতিবন্ধী

স্ত্রী আর দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে একসঙ্গে নাস্তা করে অফিসে চলে যান সিঅ্যান্ডএফ ব্যবসায়ী রেজাউল করিম। কিছু সময় পর ছেলে কলেজছাত্র সাইফ রেজাও বেরিয়ে যান। স্ত্রী রেজিয়া আক্তার আর মাধ্যমিক (এসএসসি) পরীক্ষার্থী মেয়ে সায়মা আক্তার বাসায়। খাবার টেবিলে মা-মেয়ে কথা বলছেন। এমন সময় কলিং বেলের শব্দ। সায়মা টেবিল থেকে উঠে দরজা খুলতে যায়। সায়মা ভিতর থেকে আগন্তুকের পরিচয় জানতে চায়। ‘স্কুল থেকে এসেছি’- দরজার ওপাশে অপরিচিত কণ্ঠ। তবে স্কুলের কথা বলায় সায়মা ভিতর থেকে দরজা খুলে দেয়। দরজার সামনে এক যুবক। তাকে দেখে সায়মার কেমন যেন সন্দেহ হয়। ভিতরে ঢুকতে না দিয়েই প্রশ্ন রাখে, ‘কী ব্যাপারে এসেছেন?’ যুবকটি কিছু বলার আগেই দরজার পাশে আড়াল হয়ে থাকা আরেক যুবক সামনে এসে দাঁড়ায়। সায়মা কেঁপে ওঠে। চেহারা ফেকাসে হয়ে যায়। কদিন ধরেই তাকে এই ছেলেটি ভীষণ উত্ত্যক্ত করছিল পথেঘাটে। সায়মা বলে, ‘আপনি এখানে কেন? কী ব্যাপার?’ এ কথা বলেই দ্রুত দরজা বন্ধ করতে যায়। কিন্তু ওই দুই যুবক দরজা ঠেলে ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করে। সায়মার হাত ধরে বাইরে টেনে আনতে চায় তারা। ‘মা, মা, তাড়াতাড়ি আসো! বাঁচাও!’ সায়মা চিৎকার করেই যাচ্ছে। যুবকরা তার মুখ চেপে ধরে ধাক্কা দিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়ে। মেয়ের এমন আর্তচিৎকারে রেজিয়া আক্তার দৌড়ে আসেন দরজার সামনে। যুবকরা তখন সায়মাকে নিয়ে ধস্তাধস্তি করছিল। ‘এই তোমরা কারা বাবা, কী ঘটনা? এমন করছ কেন?’ রেজিয়া বেগম জানতে চায়। তাদের নিবৃত্ত করার প্রাণান্ত চেষ্টা মায়ের। দুই যুবক এবার হিংস্র। একজন চাকু বের করে সায়মার মায়ের পেটে, বুকে, গলায় চালাতে থাকে। রক্ত ঝরে। ফিনকির মতো। আরেকজনের সঙ্গে সায়মার চলছিল ধস্তাধস্তি। সে অন্য যুবকের হাত থেকে চাকু নেয়। সায়মার পেটে-বুকে বসাতে থাকে। অসহায় মা-মেয়ে মানবরূপী দুই হায়েনার কাছে পরাস্ত। মেঝের ওপর লুটিয়ে পড়ে। রক্তে ভাসে মেঝে। তাদের মৃত্যু নিশ্চিত করতে পায়ের রগ কেটে দেয় তারা। দুই ঘাতকের হাত, মুখ আর শরীরের বিভিন্ন অংশে মা-মেয়ের তাজা রক্ত।

আধা ঘণ্টায় কিলিং মিশন শেষ। দুই ঘাতক এবার বাথরুমে যায়। নিজেদের শরীরে পানি ঢালে। পরিষ্কার হয়। আসার সময় ব্যাগে করে নিজেদের কাপড় নিয়ে এসেছিল। রক্তে ভেজা কাপড় পাল্টে নেয়। চুল আঁচড়িয়ে স্বাভাবিক ভঙ্গিমায় ওই বাসা থেকে বেরিয়ে যায়। ঘরে পড়ে থাকে মা-মেয়ের রক্তাক্ত লাশ। কিছু সময় পর ব্যবহারিক পরীক্ষা দিতে যাওয়ার জন্য সায়মাকে ডাকতে বাসায় আসে তার বান্ধবীরা। বার বার কলিং বেল বাজায়। সাড়া নেই। হঠাৎ চোখে পড়ে দরজা খোলা। দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে রক্তাক্ত সায়মাকে দেখতে পায়। পাশেই পড়ে আছেন সায়মার মা রেজিয়া। তারা চিৎকার করে আশপাশের লোকজন ডাকে। মা মেয়েকে হাসপাতালে পাঠানো হয়। ডাক্তার তাদের মৃত ঘোষণা করেন। ২০১৪ সালের মার্চের ঘটনা। চট্টগ্রাম আগ্রাবাদ সিডিএ আবাসিক এলাকার ১৭ নম্বর সড়কের একটি ভবনের চার তলায় ঠিক এভাবেই খুন করা হয় মা-মেয়েকে। ঘটনার পর সংবাদ পেয়ে পুলিশ আসে। শুরু হয় তদন্ত। বিভিন্ন আলামত উদ্ধার করে পুলিশ। খুঁজে পায় রক্তমাখা কাপড় আর চাকু। কিন্তু খুনি কে বা কারা, তা নিশ্চিত হতে পারে না পুলিশ। খুনের ঘটনা জানাজানি হলে ওই ভবন ঘিরে প্রচুর মানুষ ভিড় করে। আলামত সংগ্রহের পর ঘটনাস্থল থেকে পুলিশ বেরিয়ে যায়। ভিড় করা স্থানীয় লোকজন নানা ধরনের কথা বলছিল নিজেদের মধ্যে। পুলিশের এক কর্মকর্তার চোখ আটকে যায় একজনের দিকে। ওই কর্মকর্তা দেখতে পান একটু ফাঁকে দাঁড়িয়ে এক ব্যক্তি আরেকজনকে কিছু বোঝানোর চেষ্টা করছেন। পুলিশ কর্মকর্তাটি বিষয়টি বুঝতে চান। কাছাকাছি গিয়ে তিনি বুঝতে পারেন, লোকটি বাকপ্রতিবন্ধী। পাশের লোকটিকে ওই ভবন দেখিয়ে হাত ছুড়ে নানা ভঙ্গিমায় কী যেন বোঝানোর চেষ্টা করেই যাচ্ছেন। তিনি সামনে গেলে, তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেন ব্যক্তিটি। কিন্তু হায়! পুলিশ তার ভাষা বুঝতে পারে না। পুলিশ এটা বুঝতে পারে, এই ব্যক্তির কাছ থেকে হয়তো গুরুত্বপূর্ণ কোনো তথ্য মিলবে। পুলিশ চট্টগ্রামের একটি অটিস্টিক স্কুলে গিয়ে একজন শিক্ষককে ডাকেন। তাকে সঙ্গে করে নিয়ে যান সেই বাকপ্রতিবন্ধী ব্যক্তির বাসায়। এবার সেই শিক্ষকের কাছে বলতে থাকেন। সেই শিক্ষক পুলিশকে জানায়, সেই ব্যক্তিটি দুজনকে দেখেছেন বেরিয়ে যেতে। পরে দেখলেও চিনবেন। ছবিতেও চিনতে পারবেন দুজনকে। পুলিশ একটু আশ্বস্ত হয়। যাক, একটা সূত্র মিলেছে খুনি শনাক্তের বিষয়ে। এদিকে সায়মার বাবা ও ভাইদের দাবি এই খুনের সঙ্গে স্থানীয় যুবক আবু রায়হান জড়িত। রায়হান বেশ কিছু দিন ধরেই সায়মাকে উত্ত্যক্ত করছিল। হুমকিও দিচ্ছিল সময়ে সময়ে। পুলিশ আবু রায়হানের বিষয়টি মাথায় রেখে তদন্তে এগিয়ে যায়।

পুলিশ আবু রায়হানের একটি ছবিও উদ্ধার করে। সেই ছবিটি বাকপ্রতিবন্ধী লোকটিকে দেখায়। দেখামাত্রই হ্যাঁ সূচক ইঙ্গিত করেন তিনি। পুলিশ নিশ্চিত হয়, খুনি কে। এবার খুনি ধরার মিশন। পুলিশ আবু রায়হান আর তার সহযোগীর খোঁজ করতে নানা স্থানে অভিযান চালায়। কিন্তু তার খোঁজ পায় না। জোড়া খুনের এ বিষয়টি এতটাই আলোচিত হয়ে ওঠে যে, সারা দেশেই খুনিদের গ্রেফতারে রেড অ্যালার্ট জারি করা হয়। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশও (ডিবি) তার খোঁজে অনুসন্ধান চালায় বিভিন্ন স্থানে। ডিবির কাছে খবর আসে, রায়হান আছে ঢাকার ফকিরাপুলের আবাসিক হোটেল ‘আসরে’। ডিবির অভিযান ব্যর্থ হয়। রায়হান সেখানে উঠলেও সে তা ছেড়ে অন্য হোটেলে চলে যায়। ডিবি তার মোবাইল ট্র্যাকিং করে ফের। এবার পুলিশের অভিযান সফল। ফকিরাপুলের ‘মুনস্টার’ হোটেলের ২০২ নম্বর রুম থেকে রায়হানকে পাকড়াও করা হয়। তাকে চট্টগ্রাম পুলিশের কাছে তুলে দেওয়া হয়। রায়হানের তথ্যমতে তার সহযোগীকে গ্রেফতার করা হয় চট্টগ্রাম থেকে। সহযোগীর নাম শহীদ। সে পেশায় গাড়িচালক। এই জোড়া খুনে অংশ নিতে তাকে ১০ হাজার টাকায় ভাড়া করেছিল রায়হান। পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, খুনি যেখানেই লুকিয়ে থাকুক, তারা ধরা পড়বেই। খুন করে কেউ কখনো লুকিয়ে থাকতে পারেনি। কোনো না কোনো সূত্রে ধরা তাকে পড়তেই হয়। তিনি বলেন, সায়মার পরিবার যদি আরও একটু সচেতন হতো, উত্ত্যক্তকারীর বিষয়ে ব্যবস্থা বা আইনের আশ্রয় নিত, তবে এভাবে দুটি প্রাণ হয়তো নাও যেতে পারত।

যেভাবে মা-মেয়েকে হত্যা : গ্রেফতারের পর রায়হান নিজেকে সায়মার প্রেমিক দাবি করে হত্যার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছে গোয়েন্দাদের কাছে। জানা গেছে, হত্যাকান্ডের পর শহীদ চট্টগ্রামেই লুকিয়ে থাকে। কিন্তু রায়হান রাতেই বাসযোগে ঢাকায় চলে এসে প্রথমে মালিবাগে তার এক বন্ধুর বাসায় ওঠে। সেখান থেকে পরদিন সকালে প্রথমে ফকিরাপুলের হোটেল আসরে ওঠে। এরপর রাত ৮টার দিকে ওই হোটেল পরিবর্তন করে একই এলাকার হোটেল মুনস্টারে ওঠে। এরপর তার পরিকল্পনা ছিল বিমানবন্দর হয়ে দুবাই চলে যাওয়ার। দুবাইতে তার বড় ভাই থাকেন। রায়হান দাবি করেছে, তার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক ছিল সায়মার। তবে তদন্তে জানা গেছে, দেড় বছর ধরে সে উত্ত্যক্ত করত সায়মাকে। সায়মা এড়িয়ে চলার চেষ্টা করায় ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে রায়হান। ২০১৪ সালের ২২ মার্চ রায়হান তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু শহীদের সঙ্গে দেখা করে সায়মাকে বাসা থেকে জোরপূর্বক তুলে নিয়ে বিয়ে করার পরিকল্পনা করে। এতে বাধা পেলে হত্যার পরিকল্পনাও করা হয়। এ পরিকল্পনা অনুযায়ী সবকিছু ঠিক থাকলে সহযোগিতার বিনিময়ে বন্ধু রায়হানের কাছে ১০ হাজার টাকা দাবি করে শহীদ। এ ছাড়া সায়মার বাসা থেকে সোনার অলঙ্কারসহ নগদ টাকা লুট করতে চায় শহীদ। তার এসব শর্তে রাজি হয় রায়হান। এরপর ২৪ মার্চ সকাল সাড়ে ১০টার দিকে রায়হান ও শহীদ একটি অটোরিকশায় করে আগ্রাবাদের সিডিএ আবাসিক এলাকার ১৭ নম্বর সড়কের ১২৯ নম্বর ভবন যমুনার সামনে যায়। ওই ভবনের চতুর্থ তলায় সায়মাদের ফ্ল্যাট। ওখানে গিয়ে তারা খুনের ঘটনা ঘটায়।

বিচার : মা-মেয়ে হত্যার দায়ে রায়হান ও শহীদকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ড কার্যকরের আদেশ দিয়েছে চট্টগ্রামের একটি আদালত। ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে চট্টগ্রাম বিভাগীয় দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক বহুল আলোচিত মামলাটির এ রায় দেন।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর