শুক্রবার, ১১ জুন, ২০২১ ০০:০০ টা

খুনের জন্য ৯ বছর অপেক্ষা

মির্জা মেহেদী তমাল

খুনের জন্য ৯ বছর অপেক্ষা

২০১১ সালের ১৪ মার্চ নিখোঁজ হন সুজন (২৬)। চার দিন পর তার লাশ মিলে। ১৮ মার্চ দুপুরে সবুজবাগের দক্ষিণ রাজারবাগ (বাগপাড়া) শেষ মাথার খাল থেকে তার লাশ উদ্ধার হয়। সুজনের অর্ধগলিত লাশ তার পরিবার শনাক্ত করে। সুজনের বাবা ঠিকাদার আবদুল মান্নান সবুজবাগ থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। মামলাটি সবুজবাগ থানা ও ডিএমপির গোয়েন্দা পুুলিশ সাত বছর তদন্তের পর আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে। তবে ডিবির অভিযোগপত্রের বিরুদ্ধে নারাজি দেন সুজনের বাবা। এরপর মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পায় পিবিআই। তদন্ত করতে গিয়ে পিবিআই জানতে পারে, ২০০৮ সালের দিকে সুজনের সঙ্গে একই এলাকার ইভা নামে এক তরুণীর বিয়ে হয়েছিল। তবে এক বছর পরই ২০০৯ সালে সুজনকে তালাক দেন ইভা। তালাক দিলেও সুজন তার সাবেক স্ত্রী ইভার বাড়ির আশপাশে যাওয়া-আসা করতেন। সুজন ওই এলাকায় যাতায়াত করায় ক্ষিপ্ত হয় ইভার ভাই আরিফ, তার বন্ধু ফাইজুল ও ইভা। সুজনকে ওই এলাকায় যাওয়ার কারণে কয়েকবার মারধরও করেন তারা। এরপরও সুজন ওই এলাকায় যেতেন। ইভার সঙ্গে তার ভাইয়ের বন্ধু ফাইজুলের প্রেমের সম্পর্ক থাকায় ফাইজুলও চাইতেন না সুজন ওই এলাকায় যাক। এ কারণে সুজনকে হত্যা করা হতে পারে বলে তার বাবার সন্দেহ ছিল শুরু থেকেই। এজাহারেও তিনি এ বিষয়টি উল্লেখ করেছিলেন। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ সুজন হত্যার অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করলেও মামলার আসামি আসমা আক্তার ইভা, আরিফুল হক ওরফে আরিফ ও রানা ওরফে বাবু গ্রেফতার না হওয়ায় এবং তাদের পূর্ণাঙ্গ নাম ও ঠিকানা না পাওয়ায় তাদের অভিযোগপত্র থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। এতে নাখোশ হয়ে অভিযোগপত্রের বিষয়ে নারাজির আবেদন করেন সুজনের বাবা মামলার বাদী আবদুল মান্নান। আদালত পিবিআইকে মামলাটি তদন্তের নির্দেশ দেয়। পিবিআই, ঢাকা মেট্রোর (উত্তর) এস আই মো. ফরিদ উদ্দিন মামলাটির তদন্তভার গ্রহণ করেন। পিবিআইর গোয়েন্দা তথ্য ও আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে হত্যাকান্ডের ঘটনায় জড়িত আসামিদের অবস্থান নিশ্চিত হয়। সুজনের হত্যাকান্ডে জড়িত অন্যতম আসামি মো. ফজলু ওরফে কুটি (৪২)-কে ২০২০ সালের ১০ আগস্ট রাতে রাজধানীর মুগদার জান্নাতবাগ এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়। এর আগে পিবিআই এই হত্যার সঙ্গে জড়িত আসামি আসমা আক্তার ইভা, মো. আরিফুল হক ওরফে আরিফ ও রানা ওরফে বাবুকে গ্রেফতার করে। তাদের মধ্যে আসামি মো. আরিফুল হক ওরফে আরিফ হত্যার ঘটনায় নিজের জড়িত থাকাসহ তার সহযোগী অন্য আসামিদের নাম উল্লেখ করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।

যেভাবে হত্যা করা হয় সুজনকে : গ্রেফতারকৃত আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদে পিবিআই জানতে পারে, ২০০৮ সালে ভিকটিম সুজনের সঙ্গে ইভার বিয়ে হয় এবং ২০০৯ সালে ইভা সুজনকে ডিভোর্স দেন। কিন্তু ইভাকে খুবই ভালোবাসতেন সুজন। তালাক দেওয়ার পরও সুজন প্রায় সময় ইভাকে দেখার জন্য তাদের এলাকায় যাওয়া-আসা করতেন। এদিকে ইভার সঙ্গে সুজনের বিয়ে হওয়ার আগে থেকেই ফাইজুল নামে স্থানীয় এক তরুণ ইভাকে পছন্দ করতেন। ইভার বড় ভাই আরিফের সঙ্গে ফাইজুল বন্ধুর মতো চলাফেরা করতেন। ফাইজুল বিভিন্ন সময় ইভাদের বাসায় আসা-যাওয়া করতেন। এটা নিয়ে ফাইজুল ও ইভার বড় ভাই আরিফের সঙ্গে সুজনের বিভিন্ন সময় তর্কবিতর্ক ও হাতাহাতি হয়। সুজন তখন ইভার ভাই আরিফকে চড়-থাপ্পড় দেন। এর ধারাবাহিকতায় হত্যাকান্ডের ৭/৮ দিন আগে সুজনকে মারধর করেন ফাইজুল। ২০১১ সালের ১৩ মার্চ সন্ধ্যার পর আরিফুল হক ও ফাইজুল তাদের বন্ধু কুটি ও কালা বাবুকে নিয়ে বাসার সামনের মাঠে বসে সুজনকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। এরপর পরিকল্পনা অনুযায়ী, ওই বছরের ১৪ মার্চ সন্ধ্যা সাতটার সময় আরিফ তাদের বাসার পাশের চায়ের দোকান থেকে একটি সাদা পলিথিন ব্যাগ নেন। ফাইজুল ও আরিফ লাঠি নিয়ে খালপাড় বালুর মাঠের দিকে যেতে থাকেন। এরই মধ্যে কুটিও চলে আসেন। তারা তিনজন একসঙ্গে খালপাড় বালুর মাঠে অপেক্ষার কিছুক্ষণের মধ্যেই কালা বাবুও চলে আসেন। রাত আনুমানিক ৮টায় কুটির সঙ্গে যোগাযোগ করে সুজন খালপাড় বালুর মাঠে আসেন। বিভিন্ন কথাবার্তার একপর্যায়ে ফাইজুল পেছন থেকে সুজনের দুই হাত চেপে ধরেন। আরিফ পকেট থেকে পলিথিন বের করে কুটিকে দেন। কুটি পলিথিনের ব্যাগটি সুজনের মাথার ওপর থেকে গলা পর্যন্ত নামিয়ে পেঁচিয়ে গিট দিয়ে ফেলেন। একই সময়ে আরিফ লাঠি দিয়ে সুজনকে পেটাতে থাকেন। পরে কালা বাবু আরিফের হাত থেকে লাঠি নিয়ে সুজনকে পেটাতে থাকে। এর কিছুক্ষণ পরই সুজন মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। সুজন মারা গেছেন নিশ্চিত হয়ে তারা ধরাধরি করে লাশ পাশের খালে ফেলে দেন। কুটি ও কালা বাবু খালে নেমে সুজনের লাশ পানিতে ভাসিয়ে দেন। পরে তারা সবাই এলাকায় চলে আসেন। পিবিআই জানায়, সুজনের সাবেক স্ত্রীর ভাই আরিফ এই হত্যাকান্ডের কথা স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। এই হত্যার সঙ্গে জড়িত পাঁচজনের মধ্যে চারজনকেই গ্রেফতার করা হয়।

হত্যার পর লাপাত্তা ইভার পরিবার : সবুজবাগের রাজারবাগ এলাকায় পরিবার নিয়ে থাকতেন মো. ইউনুস আলী। ওই এলাকায় একটি রিকশার গ্যারেজ ছিল তার। ইউনুস আলীর দুই ছেলে ও এক মেয়ে। আরিফ, বাবু ও ইভা। তাদের গ্রামের বাড়ি শরীয়তপুরের নড়িয়া এলাকায়। তবে শরীয়তপুরের বাড়িঘর বিক্রি করে অনেক আগেই তারা ঢাকায় চলে আসেন। সুজনকে হত্যার পর পুরো পরিবার লাপাত্তা হয়ে যায়। পুলিশও তাদের খুঁজে পায়নি। স্থায়ী ঠিকানায় গিয়েও তাদের না পেয়ে ডিবি পুলিশ অভিযোগপত্র থেকে তাদের নাম স্থগিত রাখে।

সৌদি আরবে পালিয়ে যায় ইভা : সুজনকে হত্যার পর ইভা পালিয়ে শ্রমিক ভিসায় সৌদি আরবে চলে যান। সেখানে কুমিল্লার লাকসামের এক ছেলের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। পরে তারা বিয়েও করেন। ইভা তার স্বামীর বাড়ি লাকসামে থাকা শুরু করেন। পিবিআই লাকসাম থেকে ইভাকে গ্রেফতার করে। ঘটনার পর তার বাবা পরিবার নিয়ে নারায়ণগঞ্জে বসবাস শুরু করেন। নারায়ণগঞ্জ থেকে মামলার অন্যতম দুই আসামি ইভার ভাই বাবু ও আরিফকে গ্রেফতার করা হয়। এই মামলায় ফাইজুল, আলমগীর ওরফে কালা বাবু ওরফে কিলার বাবু ও কুটিকে গ্রেফতার করেছিল ডিবি। তাদের মধ্যে কুটি ও কালা বাবু জামিন নিয়ে সে সময় পালিয়ে যান।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর