রবিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

গেঞ্জির রং চেনাল খুনিকে

মির্জা মেহেদী তমাল

গেঞ্জির রং চেনাল খুনিকে

দেশি-বিদেশি ভ্রমণপিপাসুদের কাছে জনপ্রিয় এক পর্যটন কেন্দ্র সিলেটের জাফলং। জাফলংয়ের সৌন্দর্য উপভোগ করতে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শত শত নারী-পুরুষের সমাগম ঘটে। প্রতিদিনই সকাল থেকে রাত অবধি নারী-পুরুষের পদচারণায় মুখরিত থাকে জাফলং। তবে গেল বছর করোনার জন্য জাফলংয়ে পর্যটকের চাপ ছিল কিছুটা কম। সেদিনও পর্যটকের ভিড় ছিল। সারা দিন ভালোভাবে কাটলেও বিকালের পর জাফলংয়ে ছড়িয়ে পড়ে আতঙ্ক। জাফলং গ্রিনপার্ক এলাকার একটি টিলার ওপর পড়ে ছিল রক্তাক্ত লাশ। ঘুরতে যাওয়া কয়েক যুবকের চোখে পড়ে লাশটি। তাদের হাঁকডাকে প্রথমে ছুটে আসেন স্থানীয় নিরাপত্তা রক্ষীরা। এরপর আসে পুলিশ। মৃতদেহের ঘাড় ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে ধারালো আঘাতের ক্ষত। লাশ উদ্ধারের খবরে মুহুর্তেই পর্যটন এলাকা পর্যটকশূন্য হয়ে পড়ে। স্থানীয় লোকজন ভিড় করতে থাকেন গ্রিনপার্কের সেই টিলায়। লাশ দেখতে ভিড় করেন সেখানকার ট্যুরিস্ট গাইড, ফটোগ্রাফার আর হকাররা। পুলিশই তাদের ডেকে লাশ দেখার সুযোগ করে দেয়। কারণ ৩০ বছর বয়সের নিহত ব্যক্তির পরিচয় জানা ছিল না পুলিশের। ট্যুরিস্ট গাইডদের প্রায় প্রত্যেকেই লাশ দেখেই চিনে ফেলেন। লাশটি তাদেরই মতো একজন ট্যুরিস্ট গাইড কাম ফটোগ্রাফারের। তার নাম সাদ্দাম হোসেন। জাফলংয়ের কালিনগর গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন। তার হাতে সব সময় ক্যামেরা থাকত। পুলিশের ধারণা, এটি ছিনতাইকারীদের কাজ। ঘটনাটি ২০২০ সালের ১৫ জুলাইয়ের।

জাফলংয়ের মতো জনপ্রিয় একটি পর্যটন কেন্দ্রে এমন খুনের পর পর্যটকদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। পুলিশ প্রশাসনকেও ভাবিয়ে তোলে এ খুনের ঘটনা। গোয়াইনঘাট থানায় মামলা দায়ের করা হয়। সাদ্দামের লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠায়। ঘটনাস্থল থেকে একটি রক্তমাখা ছুরি উদ্ধার করেছে পুলিশ। থানা পুলিশের পাশাপাশি বিভিন্ন সংস্থা এ খুনের তদন্ত শুরু করে। প্রতিদিনের মতো সেদিনও সকাল সাড়ে ৮টার দিকে ক্যামেরা নিয়ে পর্যটকদের ছবি তুলতে পর্যটন কেন্দ্র সংগ্রাম বিজিবি ক্যাম্প এলাকায় যাওয়ার জন্য সাদ্দাম বাড়ি থেকে বের হন। এরপর বিকলে জাফলং বন বিটের গ্রিনপার্ক এলাকায় স্থানীয় লোকজন তার লাশ পড়ে থাকতে দেখে থানা পুলিশকে খবর দেন। স্থানীয় পুলিশের পাশাপাশি পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন-পিবিআই ‘ছায়া তদন্ত’ শুরু করে। ক্লুলেস এ খুনের তদন্ত শুরু করতে গিয়েই বিপাকে পড়ে পুলিশ। পুলিশের ধারণা, এটি ছিনতাইকারীদের কাজ। স্থানীয়রাও বলছেন, ছিনতাকারী ছাড়া আর কেউ এভাবে খুন করার কথা নয়। কারণ, সাদ্দাম হোসেনের মোবাইল ফোন আর ডিএসএলআর ক্যামেরাও নিয়ে গেছে। সাদ্দামকে মেরে ফেলার মতো কোনো শত্রু ছিল না বলেও পুলিশ নানাভাবে জানতে পেরেছে। পুলিশ ঘটনাটি ছিনতাই বলে মেনে নিয়েই তদন্ত শুরু করে। স্থানীয় লোকজনকেও জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। কয়েকজনের কাছ থেকে পুলিশ জানতে পারে, সেদিন জাফলং এলাকায় সাদ্দামকে সবাই দেখেছে পর্যটকদের ছবি তুলতে। টিলায় ওঠার সময় অনেকের নজরেও পড়েছে। তবে তার সঙ্গে দুই তরুণ পর্যটক ছিলেন। তাদের ছবিও তুলেছিলেন টিলার নিচে থাকতে। পুলিশ সেই দুই পর্যটক সম্পর্কে খোঁজ নিতে শুরু করে। কয়েকজনের কাছ থেকে পুলিশ একটি বিষয়ে অভিন্ন তথ্য পায়। তা হলো যে দুজনকে দেখা গেছে তাদের একজনের পরনে ছিল গেঞ্জি। সেই গেঞ্জির রং অফ হোয়াইট। পুলিশ শুধু এ টুকু তথ্য নিয়েই খুনি শনাক্তে মাঠে নামে। গেঞ্জির রং ধরে তদন্ত করতে গিয়ে সিলেটের বিভিন্ন হোটেলে খোঁজখবর নিতে শুরু করে। কিন্তু তাদের সূত্রের সঙ্গে মেলে না। বিভিন্ন হোটেলের সিসি ক্যামেরার ফুটেজেও পাওয়া যায় না সন্দেহভাজনদের। এক সময় পিবিআই জানতে পারে ১৪ জুলাই এক কিশোর ও এক যুবক সিলেটের কদমতলী টার্মিনাল এলাকার হোটেল আল হকে রাতযাপন করেছেন। এ তথ্য পেয়েই পুলিশ সোজা চলে যায় সেই হোটেলে। হোটেলের রেজিস্টারে লেখা সন্দেহভাজনদের একজনের নাম সজল, অপরজন সাগর। এরা সেই হোটেলে রাত্রিযাপন করেছেন। তাদের মোবাইল ফোন নম্বর নিয়ে পুলিশ প্রযুক্তির সহায়তা নেয়। এরই মধ্যে পেরিয়ে যায় ১০ দিন। পুলিশ মোবাইল ট্র্যাকিং করে জানতে পারে ঘটনার সময় তাদের অবস্থান ছিল সেই টিলায়। পুলিশ নিশ্চিত, খুনি এরাই। তাদের অবস্থান নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে। পুলিশ আর অপেক্ষা করে না। রূপগঞ্জের চনপাড়া থেকে সজল ও সাগরকে গ্রেফতার করে পুলিশ। সাগরের প্রকৃত নাম হুমায়ুন কবির। জাফলংয়ের হোটেলে সাগর নামে রেজিস্টারে নাম লিখিয়েছিলেন। দুজনই সেই বিকালে খুনের ঘটনাটি স্বীকার করে নেন। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় সাদ্দামের ক্যামেরা ও মোবাইল ফোন। জব্দ করা হয় হত্যায় ব্যবহৃত ছোরাও।

জাফলংয়ে গিয়ে ছবি তোলার কথা বলে সাদ্দামকে সঙ্গে নেন হুমায়ুন ও সজল। এরপর তারা একটি নির্জন টিলার ওপর যান। সেখানে হুমায়ুনের ছবি তোলার সময় সজল পেছন থেকে সাদ্দামের ঘাড়ে ছুরিকাঘাত করেন। একপর্যায়ে সজলের হাত থেকে ছুরি পড়ে গেলে তা তুলে এনে হুমায়ুনও ছুরিকাঘাত করেন। এরপর ক্যামেরা ও মোবাইল ফোন নিয়ে তারা পালিয়ে যান। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ থানার চনপাড়ার (পুনর্বাসন কেন্দ্র) দীন ইসলামের ছেলে মো. হুমায়ুন (১৫) ও মো. সানীর ছেলে মো. সজল (২০)। এর মধ্যে সজল পেশায় বাসের হেলপার ও হুমায়ুন জুতার দোকানের সেলসম্যান। পর্যটকবেশে তারা সিলেট এসেছিলেন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর