মঙ্গলবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

পঞ্চাশ গ্রামে ১৭ দিন

মির্জা মেহেদী তমাল

পঞ্চাশ গ্রামে ১৭ দিন

গ্রামের পর গ্রাম, কখনো কাদামাটির রাস্তা, কখনো শক্ত ইটের ক্লিপিং পথ। কখনো গাড়িতে, আবার কখনো পায়ে হেঁটে চলতে চলতে দিন গড়িয়ে আঁধার নামে। কিন্তু পথ চলা যেন শেষ হচ্ছে না। ঢাকা থেকে একদল সাদা পোশাকের পুলিশ ময়মনসিংহের প্রত্যন্ত অঞ্চল আর গফরগাঁওয়ের চরাঞ্চলে মাইলের পর মাইল চষে বেড়াচ্ছেন। কিন্তু পৌঁছাতে পারছে না টার্গেটের কাছে। দিনের পর দিন এভাবেই চলতে চলতে গোয়েন্দারা একটা সময় হাঁপিয়ে ওঠেন। কিন্তু পথচলা তাদের বন্ধ হয় না। গ্রামের সন্দেহভাজন ঘরে ঘরে চলে তাদের তল্লাশি। কখনো হকারের ছদ্মবেশে। কখনো আবার ভ্যানচালক বা নৌকার মাঝি হয়ে। ঢাকার লালবাগ থেকে অপহৃত হওয়া শিশু রাজুকে উদ্ধারে এভাবেই একদল পুলিশ ঘুরে বেড়াচ্ছেন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। ঘটনাটি ১৯৮২ সালের। পুলিশ দলের প্রতিজ্ঞা ছিল অপহৃত শিশুকে উদ্ধার করে তবেই ফিরবে তারা ঢাকায়। আর এই দলের নেতৃত্বে ছিলেন লালবাগ থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আকরাম হোসাইন। যিনি পরবর্তীতে গোয়েন্দা পুলিশের এসি আকরাম নামে সারা দেশে আলোচিত ছিলেন। তৎকালীন সময়ে এই দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন যাদের কেউ এখন আর চাকরিতে নেই। মারাও গেছেন কেউ কেউ। অবসরে থাকা কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপ করে শিশু রাজু উদ্ধারের ঘটনা জানা যায়। সেসময় ওসি আকরামের নেতৃত্বে রাজুকে উদ্ধার করা হয়েছিল ঠিকই, তবে তাদের ১৭ দিন টানা অভিযান চালাতে হয়েছে। অন্তত ৫০ গ্রামে তাদের তল্লাশি চালাতে হয়।

১৯৮২ সালের কথা। তৎকালীন অবিভক্ত লালবাগ থানার ওসি ছিলেন আকরাম হোসাইন। লালবাগ থানার আলী নেকির দেউরি এলাকা থেকে রাজু নামের দুই-তিন বছরের একটি শিশু  ছেলেকে অপহরণ করা হয়। বিষয়টি ওই সময় পত্রিকায় ফলাও করে প্রকাশিত হয়। শিশু অপহরণের মতো নির্মম অপরাধকে  কেন্দ্র করে সারা দেশে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। আকরাম হোসাইন এই অপহরণের রহস্য উদঘাটন ও অপহরণকারী চক্রকে আটকে মরিয়া হয়ে ওঠেন। শিশুটির বাসা লালবাগ থানার আলী নেকির দেউরিতে। তার বাবা চকবাজারের বড় ব্যবসায়ী। হঠাৎ বাসা থেকে শিশুটি নিখোঁজ হয়ে যায়। শিশুটির পরিবার অপহরণের বিষয়ে নির্দিষ্ট কাউকে সন্দেহও করতে পারছিল না। তবে কিছুদিন আগে তাদের দোকানের এক কর্মচারীকে রাজুর বাবা বেশ গালমন্দ করেন। এরপর কর্মচারী আর দোকানের চাকরিতে আসেনি। এমন তথ্য পুলিশকে জানানো হয়। এই ক্লু ধরেই এগোতে থাকলেন পুলিশ অফিসার আকরাম হোসাইন। তখন কর্মচারীদের জীবনবৃত্তান্ত রাখা হতো না। এখনকার মতো এনআইডিও ছিল না। পরিচিত কেউ দোকানে কাজে লাগিয়ে দিতেন। যে কারণে ওই দোকান কর্মচারীর গ্রামের ঠিকানা তাৎক্ষণিক সংগ্রহ করা কঠিন ছিল। বিপাকে পড়লেন ওসি আকরাম। এরপরও থেমে থাকেননি তিনি। প্রথমে যে দোকান কর্মচারী ওই ছেলেকে কাজে লাগিয়ে দিয়েছিল তার খোঁজ করতে থাকে ওসি আকরাম। তাকে পেয়েও যান। কিন্তু তিনি সেই ছেলেটির সঠিক ঠিকানা জানেন না। শুধু বলতে পারে গফরগাঁওয়ের চরাঞ্চল এলাকা। আকরাম তার দল নিয়ে চরাঞ্চল এলাকায় অভিযান পরিচালনার পরিকল্পনা নেন। শুরু হয় তাদের উদ্ধার অভিযানের যাত্রা। এরপর গ্রামের পর গ্রামে চলে তাদের অভিযান। বিরামহীন অভিযান যেন শেষ হচ্ছিল না। তারা অভিযান চালাতে থাকে ময়মনসিংহ আর গফরগাঁয়ে। দীর্ঘ ১৭ দিন পর এভাবেই এসি আকরাম পৌঁছে যান রাজুকে অপহরণকারীদের আস্তানায়। নিগুয়াইর ইউনিয়নের একটি গ্রামের ঘরের খিল দেওয়া কাঠের দরজা নক করতেই খুলে দেন এক নারী। টর্চের আলো ঘরে পড়তেই নজরে আসে শিশু রাজু। যখন শিশু রাজুর কাছে আকরামের দল পৌঁছান তখন রাত ১২টা। গ্রামের টিনের ঘরের  ছোট্ট একটি রুমের মাটিতে ধাড়ির বিছানায় ঘুমিয়েছিল রাজু। দরজা খুলে ঘরে প্রবেশ করেই আকরাম হোসাইন পরম মমতায়  কোলে তুলে নেন রাজুকে। টানা ১৭ দিনের অভিযান শেষে শিশু রাজুকে নিয়ে ঢাকায় ফিরে পুলিশের দল। রাত গড়িয়ে সকালে তারা যখন আলী নেকির  দেউরির মহল্লায় রাজুদের বাসার সামনে পৌছেন, তখন এলাকার শত শত লোকের ভিড়। রাজুকে তার মায়ের বুকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। শিশু সন্তানকে বুকে পেয়ে মায়ের আনন্দে তখন অনেকেই কেঁদেছিলেন। অপহরণকারী সেই যুবকটিকে পাঠানো হয় কারাগারে।

 

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর