শিরোনাম
রবিবার, ৩ অক্টোবর, ২০২১ ০০:০০ টা

চাপে চিড়েচ্যাপটা নিম্ন ও মধ্যবিত্ত

পণ্যমূল্য বাড়ছে তো বাড়ছেই, এখনো কাজহীন বহু মানুষ

মানিক মুনতাসির

চাপে চিড়েচ্যাপটা নিম্ন ও মধ্যবিত্ত

সুজন ব্যাপারী। বয়স ৩৫। থাকেন রাজধানীর রামপুরা এলাকায়। কাজ করতেন একটি টেইলারিং হাউসে। চলতি বছরের শুরুতে সাধারণ ছুটি চলাকালে কাজ হারিয়েছেন। এখনো বেকার। মাঝে-মধ্যে রিকশা চালান। আবার কখনো কখনো ফেরি করে চা বিক্রি করে দুই সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে সংসার চালাচ্ছেন। তিন মাসের ঘরভাড়া বকেয়া পড়েছে ১২ হাজার টাকা। একটা এনজিও থেকে ২০ হাজার টাকা ঋণের আবেদন করেছেন। ঋণটা পেলে চায়ের ব্যবসাটা নিয়মিত করবেন বলে ভাবছেন। পাশাপাশি বকেয়া পড়া বাড়িভাড়ার একটা অংশ পরিশোধ করবেন। এমন পরিস্থিতি শুধু সুজনের নয়, করোনা মহামারী মানুষের শুধু জীবনকেই সংক্রমিত করেনি, বরং জীবনধারণকে দাঁড় করিয়েছে এক অসহনীয় অবস্থার মুখে। প্রায় সব মানুষেরই আয় কমেছে। অথচ জীবন ধারণের ব্যয় বাড়ছে প্রতিনিয়ত।

কয়েক মাস ধরে টানা পণ্যমূল্য বাড়ছে তো বাড়ছেই। মোটা চালও এখন ৫০ টাকা কেজি। পিঁয়াজ, রসুন, তেল, চিনি, ব্রয়লার মুরগি, ডিমের বাজারও চড়া। এক লিটার সয়াবিন কিনতে হচ্ছে ১৫০ টাকায়। চিনির দাম বেঁধে দেওয়া হলেও নির্ধারিত দামে বাজারে চিনি বিক্রি হচ্ছে না। খুচরা বিক্রেতারা দুষছেন পাইকারদের, আর পাইকাররা দুষছেন ডিলারদের। মাছ আর কাঁচাবাজারের আড়তেও ঊর্ধ্বমুখিতা। খুচরা বাজারে ৫০ টাকার নিচে কোনো সবজি নেই। ছোট সাইজের একটা লাউ কিনতে হয় ৫০-৬০ টাকায়। সাইজ বড় হলে ৮০ টাকা। আলুর কেজিও ২৫ টাকা। গরিবের আমিষ হিসেবে খ্যাত ব্রয়লার মুরগির কেজি ১৬০ টাকা। এক ডজন ডিমের দাম ১২০ টকা। ডাবল সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছে কাঁচামরিচ। আমদানি করা এক কেজি মোটা ডালের দাম ৮০ টাকা। এক কেজি শসার দাম ৮০ টাকা। ভরা মৌসুমে ইলিশের বাজারও চড়া। ফলে দ্রব্যমূল্যের চাপে চিড়েচ্যাপটা হচ্ছেন নিম্ন ও মধ্যবিত্তরা। কই, পাঙ্গাশ, সিলভার কার্প, নলা, তেলাপিয়া মাছও কিনতে পারছেন না নিম্ন আয়ের মানুষ। এসব মাছের দামও প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে তিন মাসের ব্যবধানে।

এদিকে খোদ সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএস বলছে, করোনা মহামারীর আঘাতে অন্তত ১ কোটি ৬০ লাখ মানুষ নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাচ্ছে। আর বেসরকারি গবেষণা সংস্থা ব্র্যাক ও পিপিআরসি বলছে, আগে দেশের ২০ শতাংশ মানুষ দরিদ্র ছিল। এখন তা আরও ৫ শতাংশ বেড়ে ২৫ শতাংশে উঠেছে। সামনের দিনে এ সংখ্যা আরও বাড়বে বলে মনে করে সংস্থা দুুটি। ফলে করোনা-পরবর্তী সময়ে মানুষের কাজের সুযোগ বাড়াতে হবে। বিশেষ করে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষকে কাজ দিতে না পারলে দারিদ্র্যসীমা ভয়াবহতার দিকে এগিয়ে যাবে। এতে সব ধরনের উন্নয়ন কার্যক্রমই বাধাগ্রস্ত হবে। মহামারী করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে টানা লকডাউনে কাজ হারিয়েছেন অসংখ্য মানুষ। বেশির ভাগ কর্মজীবীর আয়ই কমেছে। নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রায় সব মানুষেরই নাভিশ্বাস উঠেছে জীবন চালাতে। সংসার চালাতে না পেরে অনেকেই ঢাকা ছেড়েছেন, ছাড়ছেন। মহামারী রূপ নেওয়া করোনাভাইরাস থেকে রেহাই পেতে রীতিমতো যুদ্ধ করছে বিশ্ববাসী। এর প্রভাবে বৈশি^ক অর্থনীতি ধসে পড়েছে। লোকসান গোনার আশঙ্কায় বড় বড় অনেক কোম্পানি। বাংলাদেশের অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যে এর ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। যদিও দ্রুততম সময়ের মধ্যে ঘুরে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতি, সচল হয়েছে সব ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্য, কিন্তু কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণে আসছে না পণ্যমূল্য। বিশেষ করে চাল, ডাল, তেল, চিনি, মাছ, মাংস, পিঁয়াজ, রসুনের দাম বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। সরকার দর বেঁধে দিলেও মানছে না কেউই। এদিকে দীর্ঘ ভোগান্তির পর করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নেমে এসেছে ৩ শতাংশে। সব ক্ষেত্রে শুরু হয়েছে কর্মচাঞ্চল্য। এর পরও বিভিন্ন ক্ষেত্রে চলছে কর্মী ছাঁটাইয়ের আতঙ্ক। ২০২০ সালের মাঝামাঝিতে বন্ধ হয়ে যাওয়া অনেক কারাখানাই এখনো চালু হয়নি। এতে সবচেয়ে বেশি সংকটে পড়েছেন নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ। বিভিন্ন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা বলছে, বাংলাদেশে ১৬ কোটি মানুষের ৪ কোটি পরিবার আছে। এর মধ্যে নিম্নবিত্ত ২০ আর উচ্চবিত্ত ২০ শতাংশ। মাঝের যে ৬০ শতাংশ, এরা নিম্ন মধ্য ও উচ্চ মধ্যবিত্ত। এ সংখ্যা আড়াই কোটি পরিবার হবে। এর মধ্যে সরকারি চাকরিজীবী, মাল্টিন্যাশনাল ও বড় কোম্পানিতে কাজ করা কিছু মানুষ বাদে অন্যরা সবাই এখন চরম সংকটে আছেন। এদের মধ্যে বড় একটা অংশ চাকরি হারানোর ঝুঁকিতে। অনেকেরই নিয়মতি বেতন হয়নি। অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। আবার যারা দৈনিক ভিত্তিতে কাজ করেন, তাদের বেশির ভাগই এখন কর্মহীন। এ ছাড়া অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের কর্মজীবী মানুষ তো আরও বেশি কষ্টে রয়েছেন। তাদের সংকট আরও অনেক বেশি।

ব্র্যাকের চেয়ারম্যান ও পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, করোনাভাইরাস মহামারীর ফলে অসংখ্য মানুষ কাজ হারিয়েছে। দেশের বেশির ভাগ মানুষেরই আয় কমেছে। করোনার প্রথম দিকের সময়গুলোতে মানুষ ধারকর্জ করেছে বা সঞ্চয় ভেঙে জীবন চালিয়েছে। এখন কিন্তু সে অবস্থা নেই। ফলে মানুষ বাধ্য হয়ে খাবার কম খাচ্ছে। অনেকেই আবার কুলাতে না পেরে খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনছে। অর্থাৎ ভাত, আলু কিংবা ডালের পরিমাণ ঠিক রেখে মাছ-মাংস কম খাচ্ছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত নিম্ন ও মধ্যবিত্তের সংকট কাটানো কঠিন হবে। তবে এখানে সরকারের আরও অনেক কাজ করার সুযোগ রয়েছে বলে তিনি মনে করেন।

এদিকে মুরগি ও ডিমের মূল্য বৃদ্ধি প্রসঙ্গে ফিড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো. আহসানুজ্জামান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমিষের চাহিদা পূরণে ডিমের চাহিদা অপরিসীম। সম্ভাবনাময় এ খাতটি নানামুখী সংকটের আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। মুরগি পালনের পর ডিম উৎপাদনে ব্যয় অত্যধিক হলেও পর্যাপ্ত দাম মিলছে না। মুরগির খাবার তৈরিতে ব্যবহৃত সয়াবিন মিল আমদানি করে আবার তা রপ্তানি করা হচ্ছে। অথচ আামাদের চাহিদা মেটানো যাচ্ছে না। ফলে মাছ ও মুরগির খাবারের দাম বেড়েছে।’ এ কারণে মাছ, মুরগি ও ডিমের বাজার ঊর্ধ্বমুখী হচ্ছে বলে তিনি মনে করেন।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর