করোনাভাইরাসের নতুন ধরন ওমিক্রনের সংক্রমণে দেশে পণ্যের রপ্তানি ও বিক্রি কমেছে, উপরন্তু অতিরিক্ত স্বাস্থ্য সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য শিল্পোদ্যোক্তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যে ব্যয় বেড়েছে। সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)-এর উদ্যোগে পরিচালিত একটি জরিপে এসব তথ্য উঠে আসে। ‘কভিড-১৯’ মহামারির প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের আস্থা ও প্রত্যাশার ওপরে পরিচালিত সপ্তম পর্যায়ের জরিপের ফলাফল গতকাল একটি ওয়েবিনারে উপস্থাপন করা হয়।
জরিপকৃত প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ৭১ শতাংশ জানিয়েছে, ওমিক্রন সংক্রমণের প্রভাবে তাদের পণ্যের রপ্তানি বা বিক্রি কমেছে। অন্যদিকে, ৭৯ শতাংশ প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে, এ জন্য তাদেরকে অতিরিক্ত স্বাস্থ্য-সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়েছে এবং খরচও বেড়েছে। ৮২ শতাংশ প্রতিষ্ঠান জানায়, ওমিক্রনের জন্য সার্বিকভাবে পুঁজি ও শ্রমের খরচ বেড়েছে। জরিপে জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধির প্রভাবটিও উঠে আসে। ৯৭ শতাংশ প্রতিষ্ঠান জানায়, জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধির ফলে যানবাহনের খরচ বেড়েছে। ৭৯ শতাংশ প্রতিষ্ঠান জানায়, এর ফলে তাদের উৎপাদন খরচ বেড়েছে।
জরিপকৃত প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ৭৪ শতাংশ জানিয়েছে, তারা কোনো প্রণোদনা প্যাকেজ পায়নি; মাত্র ২৩ শতাংশ প্যাকেজ সুবিধা পেয়েছে। যে প্রতিষ্ঠানগুলো প্রণোদনা পেয়েছে, তাদের মধ্যে ৪০ শতাংশ জানিয়েছে, তাদের জন্য ওই প্যাকেজ যথেষ্ট নয়। ৬৫ শতাংশ প্রতিষ্ঠান জানায়, সরকারের পক্ষ থেকে আরও সাহায্য দরকার। সানেমের নির্বাহী পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান জরিপের ফলাফল তুলে ধরেন। অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রে জ্বালানির দাম বাড়ানোর বিষয়টি উদ্বেগজনক-এমন মন্তব্য করে এ সময় তিনি বলেন, জ্বালানির মূল্যের জন্য নীতিনির্ধারকদের একটি কৌশলগত, গতিশীল এবং ভবিষ্যৎমুখী নীতি গ্রহণ করা দরকার। এক্ষেত্রে জ্বালানি তেল আমদানির ওপর কর কমানোরও প্রস্তাব দেন তিনি। এ ছাড়া রেমিট্যান্স বাড়াতে প্রণোদনা বৃদ্ধি, মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য মুদ্রানীতি ও ব্যয়নীতির মধ্যে একটি ভারসাম্য আনা এবং বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে বিশেষ অর্থনৈতিক জোনভিত্তিক কর্মপন্থা গ্রহণের পরামর্শ দেন তিনি। এক প্রশ্নের জবাবে ড. সেলিম রায়হান বলেন, অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি একটি উদ্বেগজনক ইস্যু। ‘কভিড-১৯’-এর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বেশ কিছু সুপারিশ তুলে ধরা হয় ওয়েবিনারে। এগুলো হচ্ছে- খাত-ভিত্তিক স্বাস্থ্য-বিধি প্রণয়ন, টিকা কার্যক্রম ত্বরান্বিত করা এবং সংক্রমণ রোধে গৃহীত নিষেধাজ্ঞার ক্ষেত্রে আরও বাস্তববাদী চিন্তা করা, প্রণোদনা প্যাকেজের দ্রুত বিতরণ ও প্রক্রিয়া সহজীকরণ এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠানে অর্থায়নে প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা বৃদ্ধি করা।
সানেম জানায়, বাংলাদেশের আটটি বিভাগের ৩৮টি জেলার মোট ৫০২টি ক্ষুদ্র ও ছোট, মাঝারি ও বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ওপর এই জরিপ করা হয়। উৎপাদন খাতের তৈরি পোশাক, টেক্সটাইল, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, ওষুধ প্রস্তুতকারক, হালকা প্রকৌশল ও খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পের প্রতিষ্ঠান ছাড়াও সেবা খাতের পাইকারি ও খুচরা ব্যবসা, রেস্টুরেন্ট, পরিবহন, আইসিটি ও টেলিকমিউনিকেশন, আর্থিক খাত ও রিয়েল এস্টেট খাত এ জরিপের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ২০২২ সালের জানুয়ারির ৩ থেকে ২৪ তারিখের মধ্যে এই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত শীর্ষ কর্তৃপক্ষের ফোনালাপের মাধ্যমে এই জরিপ পরিচালনা করা হয়। করোনা মহামারির সময়ে বাংলাদেশের শিল্প ও সেবা খাতের পরিস্থিতি সম্পর্কে ধারণা পেতে ২০২০ সালের জুলাই মাস থেকে সানেম ধারাবাহিকভাবে তিন মাস পরপর এ জরিপ পরিচালনা করছে। এ পর্যায়ের জরিপে, বাংলাদেশের সার্বিক ব্যবসা পরিস্থিতির ওপর জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি, মুদ্রাস্ফীতি এবং ওমিক্রন ঢেউয়ের প্রভাব উঠে এসেছে। জরিপের ফলাফলে বলা হয়, আগের প্রান্তিকের চেয়ে চলতি বছরের জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রত্যাশা আগের চেয়ে কমেছে। আগের জরিপের মতোই, এ পর্যায়ের জরিপেও দেখা গেছে ব্যাংক ঋণ গ্রহণে প্রতিষ্ঠানগুলো প্রশাসনিক প্রক্রিয়া, বন্ধক, দীর্ঘসূত্রিতা, ব্যাংক-মক্কেল সম্পর্ক ইত্যাদি ক্ষেত্রে সমস্যার মুখোমুখি হয়।