বৃহস্পতিবার, ৩০ জুন, ২০২২ ০০:০০ টা

পাঁচ-ছয় সেকেন্ডে টোল দিয়ে নদী পার ছয়-সাত মিনিটে

পদ্মা পারাপারে ভোগান্তি এখন শুধুই স্মৃতি

আরাফাত মুন্না

গতকাল দুপুর ১টা। শরীয়তপুর যাওয়ার জন্য মাওয়া ঘাটে অপেক্ষা করছিলেন মাজেদা আক্তার। জানালেন, সকালেই মাওয়া এসেছিলেন প্রয়োজনে, এখন আবার ফিরবেন। বললেন, ‘আগে বাড়ি থেকে এ পাড়ে আসতে তিন-চার ঘণ্টা লাগত। এখন গাড়িতে উঠলাম আর চলে এলাম।’ বাসচালক আবদুুর রহমান বলেন, ‘এখন তো ভালো চলছি। দিনে কয়েকবার ট্রিপ দিতে পারছি। আগে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকা লাগত ফেরিঘাটে। ফেরি পার হতেও সময় লাগত। আমাগো কষ্টের দিন শেষ।’ মাজেদা ও আবদুর রহমান দুজনই সরাসরি পদ্মা সেতুর উপকারভোগী।

শুধু এ দুজনই নন, এমন গল্প দক্ষিণের ২১ জেলার প্রতিটি মানুষের। ফেরিঘাটে দীর্ঘ যানজট, ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা, লঞ্চডুবিতে মৃত্যু, খরস্রোতা পদ্মায় স্রোতের ধাক্কায় লঞ্চ-ফেরিতে ভয়ের আতঙ্ক, পাড়ে দীর্ঘ অপেক্ষার জন্য মালবাহী ট্রাকে ফল, সবজিসহ খাদ্যদ্রব্য নষ্ট হওয়া ছিল নিত্যঘটনা। এখন সেদিন শেষ। স্বপ্নের পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর মাত্র পাঁচ থেকে ছয় সেকেন্ডে টোল দিয়ে ছয় থেকে সাত মিনিটেই পার হওয়া যাচ্ছে নদী। সময় যেমন বেঁচেছে, কমেছে দুর্ভোগ ও মৃত্যুঝুঁকিও। পদ্মা পারাপারে সেসব ভোগান্তি এখন শুধুই স্মৃতি হয়ে থাকবে বলে মনে করছেন তাঁরা। ২৫ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পরদিন যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়। রবিবার প্রথম দিনই নাট-বোলটু খুলে নেওয়া, মূত্র বিসর্জন, সেতুতে গাড়ি থামিয়ে টিকটক ভিডিও বানানোর মতো বিশৃঙ্খল ঘটনা ঘটিয়েছে অনেকে। কেউ কেউ সেতুতে শুয়ে-বসে, নাচানাচি করে ভিডিও বানিয়েছে। ওইদিন রাতে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় দুজনের মৃত্যুও হয়। এর পরই নড়েচড়ে বসেন সেতু কর্তৃপক্ষ। ওইদিন রাতেই সেতুতে শৃঙ্খলা রক্ষায় কঠোর হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তারা। এর অংশ হিসেবে নিষিদ্ধ করা হয় মোটরসাইকেল চলাচল। পরদিন সোমবার সেনাবাহিনী, পুলিশ ও সেতু কর্তৃপক্ষের টহল, ভ্রাম্যমাণ আদালতের লাগাতার অভিযানে সেতুতে শৃঙ্খলা আসতে শুরু করে। গতকাল সেতুতে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলার খবর পাওয়া যায়নি।

মাওয়া টোল প্লাজায় দায়িত্বরত হাসাড়া হাইওয়ে থানার সাব-ইন্সপেক্টর আজিজুল হক বলেন, ‘সেনাবাহিনী, হাইওয়ে পুলিশ সেতুর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার জন্য কাজ করছে। নির্দেশনা অনুযায়ী কোনো ধরনের মোটরসাইকেল চলাচল করতে দেওয়া হচ্ছে না।’

আর নষ্ট হবে না সবজি : শুধু ভোগান্তি লাঘবই নয়, দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে ব্যবসার নতুন দিগন্ত তৈরি হবে বলে মনে করছেন কাঁচামাল ব্যবসায়ীরা। যাত্রাবাড়ী কাঁচামালের আড়তদার রাসেল মিয়া বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘শরীয়তপুর, মাদারীপুর ও ফরিদপুর থেকে প্রতিদিন অনেক সবজি আসে ঢাকায়। কিন্তু মাওয়া ঘাটে যানজট থাকায় কোনো কোনো দিন সবজি নষ্ট হয়ে যেত। ঈদের সময় বেশি এ ঘটনা ঘটত। অনেক দিন এত পরিমাণ সবজি নষ্ট হয়ে গেছে যে, চোখে পানি চলে আসত। এখন আর সে সমস্যা নেই। পদ্মা নদী পার হওয়া এখন মুহূর্তের ব্যাপার।’

ফেরির অপেক্ষায় আর মরবে না কেউ : পদ্মার মাঝে ফেরিতে বা ফেরির জন্য অপেক্ষায় থেকে ঘাটেই প্রাণ হারিয়েছেন অনেক মুমূর্ষু রোগী। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের আগের দিনও মাঝিরকান্দি ঘাট থেকে শিমুলিয়া (মাওয়া) ঘাটের উদ্দেশে ছেড়ে আসা কুঞ্জলতা ফেরিতে প্রাণ হারান ৭০ বছরেরবৃদ্ধা আমেনা বেগম। সুচিকিৎসার জন্য বরিশাল থেকে ঢাকার উদ্দেশে অ্যাম্বুলেন্সে নিয়ে আসছিলেন স্বজনরা। তবে পদ্মা পাড়ি দেওয়ার সময় মাঝনদীতেই প্রাণ হারান তিনি। একই ফেরিতে তাঁর নিষ্প্রাণ দেহ নিয়ে বরিশালের পথ ধরে অ্যাম্বুলেন্স। আমেনার ভাতিজা শাওন মাহমুদ সেদিন সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমার ফুপু রাতে স্ট্রোক করার পর জরুরি ভিত্তিতে সকালে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হই। এভাবে মাঝনদীতে তিনি চলে যাবেন আমরা বুঝিনি। সেতু চালু হওয়ার পর হয়তো এমন আর হবে না।’

বেসরকারি ব্যাংকে কর্মরত আওলাদ হোসেন বলেন, ‘ব্যাংকের চাকরিসূত্রে ঢাকায় বসবাস করছি। গত বছর আব্বা হঠাৎ করেই মারা যান। কিন্তু খবর শুনেও দ্রুত যেতে পারিনি। মাওয়ায় জ্যামের কারণে সাতক্ষীরায় বাড়ি যেতে ১০ ঘণ্টা লেগে যায়। তখন ভাবতাম আমি মারা গেলেও হয়তো গ্রামে লাশ নিয়ে যেতে অনেক সময় লাগবে। তবে পদ্মা সেতু যেন আমাদের অঞ্চলের জন্য আশীর্বাদ। এখন আর এত সময় লাগবে না। ধন্যবাদ প্রধানমন্ত্রীকে।’

ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে মোটরসাইকেল : শরীয়তপুর প্রতিনিধি জানান, গতকালও অনেকেই মোটরসাইকেল নিয়ে পদ্মা সেতু পারাপার হতে আসেন। তবে জাজিরা টোল প্লাজা থেকে সবাইকে সরিয়ে দিচ্ছে প্রশাসন। গতকালও টোল প্লাজা এলাকায় মোতায়েন ছিল সেনাবাহিনী, পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্য। এদিকে বাংলাবাজার ফেরিঘাট এক মাস ধরে বন্ধ। শরীয়তপুরের মাঝিরকান্দি-শিমুলিয়া ঘাট দিয়েও ফেরি চলাচল বন্ধ রয়েছে। এতে মোটরসাইকেল চালকরা চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন।

সর্বশেষ খবর