বৃহস্পতিবার, ২০ অক্টোবর, ২০২২ ০০:০০ টা

তিন যন্ত্রণা নারায়ণগঞ্জে

মাদক যানজট কিশোর গ্যাং

রোমান চৌধুরী সুমন, নারায়ণগঞ্জ

তিন যন্ত্রণা নারায়ণগঞ্জে

পুরো নারায়ণগঞ্জ যেন একটি সমস্যার পাহাড়। দেশের অর্থনীতিতে সিংহভাগ রাজস্ব দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা এই জেলা নানা কারণে আলোচিত হলেও হয়নি কাক্সিক্ষত উন্নয়ন। অবহেলা-অবজ্ঞার সঙ্গে জেলায় প্রকট হয়েছে ভয়াবহ যানজট, মাদক, কিশোর গ্যাং, জলাবদ্ধতা, ছিনতাই, হত্যার মতো অপরাধ। বিব্রতকর হলেও সত্য, ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জের প্রবেশদ্বারে ‘স্বাগতম নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন’ তোরণ দিয়ে ঢুকলেই ময়লা দুর্গন্ধে নাক চেপে ধরতে হয়। এ ছাড়া ঢাকার পড়শি হিসেবে জেলায় শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাত রয়েছে অবহেলার শীর্ষে। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডে নারায়ণগঞ্জ জেলার প্রবেশপথে সিটি করপোরেশনের তোরণের পরই ময়লার বিশাল ভাগাড়। প্রবেশ করতেই নাক চেপে ধরতে হয় যে-কাউকে। শহরের অন্তত ১০-১২টি স্পটে যত্রতত্র পড়ে থাকে ময়লা-আবর্জনা। নোংরা পরিবেশ আর ধুলোবালিতে একাকার পুরো শহর। ভোরের বর্জ্য পড়ে থাকে সেই দুপুর গড়িয়ে বিকাল পর্যন্ত। নারায়ণগঞ্জ তাই এখন ময়লার শহর। শহরে প্রবেশ করলেই পড়তে হয় যানজটের কবলে। শহরের মোড়ে মোড়ে রয়েছে ২০টির বেশি অবৈধ স্ট্যান্ড। এ ছাড়া শহর ও শহরতলির বিভিন্ন স্থানে চলছে ৩০ হাজারের বেশি অবৈধ অটোরিকশা। চাষাঢ়া থেকে ডিআইটি পর্যন্ত রাস্তার দুই পাশে থাকা বহুতল ভবন আছে ৫৫-৬০টি। দু-একটি ছাড়া কোনো ভবনের নিচে নিয়ম মেনে করা হয়নি গাড়ি রাখার পার্র্কিং জোন। এতে রাস্তার দুই পাশেই পার্কিং করে রাখা হয় শত শত গাড়ি। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে চলাচলরত গণপরিবহন নিয়ে রয়েছে গরমিল। একেকটি পরিবহনের নামে হয়তো ৫০টি বাস চালানোর অনুমতি রয়েছে। কিন্তু এরা চালাচ্ছে ২০০ বাসেরও বেশি। রাত হলেই রাস্তায় পার্ক করে রাখা হয় বাস-ট্রাকসহ নানা পরিবহন। এতে বাড়ছে যানজটের চাপ। পুরো শহর পরিণত হয়েছে যানজটের রাজ্যে। হাতের নাগালেই রয়েছে মাদক। পাড়া-মহল্লার সর্বত্র ছেয়ে গেছে মরণনেশা ইয়াবা ও ফেনসিডিল। মোবাইল সিন্ডিকেট করে বিক্রি হচ্ছে মাদক। মাদক ব্যবসায়ীদের আটক করলেও বেশ কয়েক দিন পরই এরা আবার জামিনে বের হয়ে আসছে। এসব মাদক ব্যবসায়ীর পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক অসাধুদের আশ্রয়।

শহর ও শহরতলির বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছে ৮০টির বেশি কিশোর গ্যাং। এসব গ্যাংয়ের হাতে এ পর্যন্ত গত কয়েক বছরে খুন হয়েছে ডজনখানেক। খুনের এই তালিকা থেকে বাদ যায়নি উদীয়মান কিশোর ফুটবলার, স্কুলছাত্র, ব্যবসায়ী। কিছুতেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না এই কিশোর গ্যাং। প্রায় সময় প্রকাশ্যে কিশোর গ্যাং শত শত সদস্য ধারালো অস্ত্র নিয়ে পাড়া-মহল্লায় মহড়া দিচ্ছে। সামান্য ঘটনায় পাড়া-মহল্লার বাড়িঘর ও দোকাপাট ভাঙচুরের ঘটনা ঘটছে। কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণের মূলে রয়েছে রাজনৈতিক প্রভাব। প্রভাবশালী ব্যক্তিদের আশ্রয়ে পুরো শহরে গড়ে উঠেছে উচ্ছৃঙ্খল কিশোর গ্যাং। রাজনৈতিক নেতারা বিভিন্ন মিটিং-মিছিল বা সামাবেশে লোকসমাগম ঘটাতে ব্যবহার করছেন এই কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের। আর গ্যাংয়ের সদস্যরা গড়ে তুলেছে বিশাল ছিনতাইকারী সিন্ডিকেট। নারায়ণগঞ্জের মানুষ অতিষ্ঠ এই কিশোর গ্যাংয়ের অত্যাচারে।

 মাত্র এক ঘণ্টার বৃষ্টিতে পানির নিচে তলিয়ে যায় শহর ও শহরতলির শতাধিক এলাকা। শহরের প্রধান প্রধান সড়কে হাঁটুপানি জমে সামান্য বৃষ্টিতেই। এ ছাড়া শহরতলির বিভিন্ন এলাকার অলিগলি জলমগ্ন হয়ে পড়ে। মুষলধারে বৃষ্টির কারণে নারায়ণগঞ্জের বঙ্গবন্ধু সড়কসহ শহরের প্রধান প্রধান সড়ক পানির নিচে তলিয়ে যায়। শহরের আশপাশের এলাকাসহ অলিগলিতে হাঁটুসমান পানি জমে। ড্রেন নিষ্কাশন না করার ফলে বৃষ্টি হলেই রাস্তা পানির নিচে তলিয়ে যায়। শিল্পনগরী নারায়ণগঞ্জ নানা ক্ষেত্রে উন্নত হলেও স্বাস্থ্যব্যবস্থায় অবহেলার শিকারের শীর্ষে রয়েছে। এখনো হার্টের রোগে আক্রান্ত হলে রোগীকে নিয়ে দৌড়াতে হয় ঢাকায়। কিডনি বা জটিল রোগের কোনো অপারেশন করার মতো ভালো স্বাস্থ্যব্যবস্থা এখানে নেই বললেই চলে। নেই কোনো বার্ন ইউনিট। শহরে সরকারি ৫০০ শয্যার হাসপাতাল থাকলেও সেটি নিজেই নানা রোগে আক্রান্ত। এখানে ভুল চিকিৎসায় প্রসূতি ও নবজাতকের মৃত্যুর অহরহ ঘটনা ঘটছে। শিক্ষাব্যবস্থায় নারায়ণগঞ্জের অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। উন্নত ও ভালো মানের তেমন কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এখানে নেই। নেই ভালো মানের কলেজ। নারায়ণগঞ্জের বেশির ভাগ শিক্ষার্থী ভর্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে চলে যায় ঢাকায়। নারায়ণগঞ্জে যে কয়েকটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুল রয়েছে, উচ্চবিত্তের স্ট্যান্ডার্ড বজায় রাখা ছাড়া সেগুলোর পড়াশোনায় কোনো সাফল্য নেই। এ ছাড়া জেলায় নেই কোনো পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ।

সর্বশেষ খবর