শনিবার, ৩ ডিসেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

নামমাত্র ভাতায় কষ্টের জীবন প্রতিবন্ধীদের

আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস আজ

জিন্নাতুন নূর

নামমাত্র ভাতায় এই দুর্মূল্যের বাজারে কষ্টে দিন পার করছেন দেশের লাখ লাখ প্রতিবন্ধী। অসচ্ছল প্রতিবন্ধীরা জনিয়েছেন, তাদের জন্য বরাদ্দ ভাতার পরিমাণ এতই কম যে, তা দিয়ে একজনের দৈনন্দিন খাদ্য চাহিদা পূরণই সম্ভব নয়। এর বাইরে অন্যান্য চাহিদা যেমন বস্ত্র, আশ্রয়, চিকিৎসা এবং বিনোদনের ব্যবস্থার কথা কল্পনাও করা যায় না। বাংলাদেশ সমাজকল্যাণ পরিষদের প্রকাশ করা এক গবেষণা প্রতিবেদন থেকে আরও জানা যায়, প্রতিবন্ধীদের চিকিৎসা ও শিক্ষা সুবিধা পেতেও যথেষ্ট ভোগান্তিতে পড়তে হয়। তাদের জন্য নেই কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। নেই কোনো বিনোদনের ব্যবস্থাও। বেশির ভাগ প্রতিবন্ধীকেই মানসিক চাপ, হীনমন্যতা, হতাশা, একাকিত্বতা, উদ্বিগ্নতা, বিষণœতা, মর্যাদাহীনতা এবং গ্লানিবোধের মধ্য দিয়ে জীবন কাটাতে হয়। এ অবস্থায় আজ পালন করা হবে ৩১তম আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের জন্য পরিবর্তনমুখী পদক্ষেপ : প্রবেশগম্য ও সমতাভিত্তিক বিশ্ব বিনির্মাণে উদ্ভাবনের ভূমিকা’। এ উপলক্ষে পৃথক বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ‘ন্যাশনাল সার্ভে অন পারসনস উইথ ডিজঅ্যাবিলিটিস’-এর ২০২১-এর জরিপ বলছে, দেশের ২ দশমিক ৪ শতাংশ মানুষ শারীরিক, মানসিক বা যেকোনো ধরনের প্রতিবন্ধিতার শিকার। এ হিসেবে দেশে প্রতিবন্ধী মানুষের সংখ্যা ৪৭ দশমিক ৪২ লাখ। জানা যায়, সরকার সব প্রতিবন্ধীকে মাসিক ৭৫০ টাকা হারে ভাতা দিয়ে আসছিল। ২০২২-২৩ অর্থবছরে এটি ১০০ টাকা বাড়িয়ে ৮৫০ টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে। কিন্তু এ ভাতাকে যৎসামান্য বলে উল্লেখ করেছেন প্রতিবন্ধীরা। বাংলাদেশ সমাজকল্যাণ পরিষদের অর্থায়নে ‘প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্র থেকে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি বা প্রতিবন্ধিতার ঝুঁকিতে থাকা ব্যক্তিবর্গকে সেবা প্রদান’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে অংশগ্রহণকারী প্রতিবন্ধীরা এমনটি জানান। তাদের মতে, এ ভাতার পরিমাণ ন্যূনতম ৩ হাজার হলে একজন প্রতিবন্ধী মোটামুটি তার মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে পারবেন। তারা আরও বলেন, সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে প্রদেয় প্রতিবন্ধী ভাতা, শিক্ষা উপবৃত্তি, চিকিৎসা সুবিধা, স্বাস্থ্যসেবা উপকরণ সহায়তা, প্রশিক্ষণসহ অন্যান্য সুবিধা একেবারই অপর্যাপ্ত। প্রতিবন্ধীদের চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবা বেশি প্রয়োজন হয়। কিন্তু এ সেবা পেতে যথেষ্ট হয়রানির শিকার হতে হয়। রয়েছে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অভাব এবং দেশের হাসপাতালগুলোও প্রতিবন্ধীদের চলাচলবান্ধব নয়। অন্যদিকে তীব্র মাত্রার প্রতিবন্ধী এবং যাদের পরিবারে আপনজন নেই এমন প্রতিবন্ধীদের দেখভালের জন্য দেশে পুনর্বাসন কেন্দ্র বা প্রতিবন্ধী আবাসিক সুবিধাসহ সেবা কেন্দ্র নেই বললেই চলে। প্রতিবন্ধীদের চিকিৎসাও রাজধানীকেন্দ্রিক। শারীরিক প্রতিবন্ধীদের জন্য একমাত্র সরকারি হাসপাতাল জাতীয় অর্থোপেডিক ও পুনর্বাসন হাসপাতাল। মানসিক প্রতিবন্ধীদের জন্য রয়েছে বাংলাদেশ জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট। এর বাইরে মানসিক রোগীদের জন্য বিশেষায়িত আরেকটি হাসপাতাল হচ্ছে পাবনা মানসিক হাসপাতাল। আর বিভাগীয় ও জেলা পর্যায়ে জেনারেল হাসপাতালগুলোর সঙ্গে মনোরোগবিদ্যা বিভাগ ও কমিউনিটি ক্লিনিকে সামান্য কিছু চিকিৎসা সেবা দেওয়া হয়। গবেষণায় অংশগ্রহণকারীর ৭০ শতাংশই জানিয়েছেন, কর্মক্ষেত্রে তাদের প্রশিক্ষণ, কাজের ব্যবস্থা, ঋণ সুবিধাসহ আয়বর্ধনমূলক কর্মসূচির যথেষ্ট অভাব রয়েছে। আবার প্রতিবন্ধী শনাক্তকরণ প্রক্রিয়াও তাদের জন্য একটি চরম চ্যালেঞ্জের বিষয় এবং এতে দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন হয়। এজন্য উপজেলা ও জেলা পর্যায়ের হাসপাতালে যে পরিমাণ চিকিৎসক প্রয়োজন তা নেই। বিশেষ ধরনের প্রতিবন্ধী, মানসিক প্রতিবন্ধী ও নিউরো ডেভেলপমেন্টাল ডিজঅর্ডার প্রতিবন্ধী চিহ্নিতকরণে বিশেষজ্ঞ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেই। এতে এ ধরনের ব্যক্তিদের ভাতার আওতায় আনা অত্যন্ত কষ্টকর হয়ে পড়ছে বলে সমাজসেবা কর্মকর্তা ও অন্য স্টেকহোল্ডাররা জানিয়েছেন। গবেষণায় অংশগ্রহণকারী ১৯ দশমিক ৫ শতাংশ প্রতিবন্ধী তাদের প্রতি সমাজের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির কথা জানিয়েছেন। এতে তাদের অনেকেই আত্মসম্মানবোধ গ্লানিতে ভোগেন। শতকরা ১৩ দশমিক ১ শতাংশ জানান, তারা বিভিন্ন সামাজিক আচার অনুষ্ঠান ও উৎসবে অংশ নিতে পারেন না। নারী প্রতিবন্ধীরা বিয়ে ও পারিবারিক জীবন গঠনের ক্ষেত্রে সমস্যায় পড়েন। ২ দশমিক ৮ শতাংশ অংশগ্রহণকারী জানান, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে তাদের গুরুত্ব দেওয়া হয় না। পরিবারের সদস্যদের কাছেও তারা গুরুত্ব পান না। শিক্ষার ক্ষেত্রে ১৭ দশমিক ৮০ শতাংশ চলাচলের প্রতিবন্ধকতায় ভোগেন। এ ছাড়া সহপাঠীদের অসহযোগিতা এবং শিক্ষকের যত্ন ও প্রশিক্ষণের অভাবের কথা উল্লেখ করেছেন ১৫ দশমিক ৯০ শতাংশ। পড়ালেখায় আর্থিক সমস্যার কথা উল্লেখ করেছেন ২৩ দশমিক ৮৬ শতাংশ। সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রতিবন্ধীবান্ধব শিক্ষাব্যবস্থার অভাব রয়েছে বলে জানিয়েছেন ১১ দশমিক ৩৬ শতাংশ প্রতিবন্ধী। স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সুবিধা প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য অনেক বেশি অপ্রতুল বলে উল্লেখ করেছেন শতকরা ৩৩ দশমিক ৮ শতাংশ। প্রয়োজনীয় ওষুধের অভাবের কথা উল্লেখ করেছেন ১৩ দশমিক ৯ শতাংশ। এ ছাড়া অংশগ্রহণকারীরা কর্মসংস্থানের অভাবগত চ্যালেঞ্জ, প্রশিক্ষণের অভাব, আয় করতে না পারা, সঞ্চয় করতে না পারা, ঋণের অভাব এবং কর্মক্ষেত্রে মজুরি বৈষম্যের চ্যালেঞ্জের কথা উল্লেখ করেছেন। বেশির ভাগ প্রতিবন্ধীর মধ্যে মানসিক চাপ, হীনমন্যতা, হতাশা, একাকিত্ব, উদ্বিগ্নতা, বিষণœতা, মর্যাদাহীনতা, গ্লানিবোধ কাজ করে। সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড বিশেষ করে বিনোদনমূলক কর্মকান্ডে এবং রাজনৈতিক কর্মকান্ডে প্রতিবন্ধীদের অংশগ্রহণের হার শতকরা ২২ দশমিক ১৫ শতাংশ। তারা জানিয়েছেন, বিনোদন ও খেলাধুলায় সুযোগের স্বল্পতা রয়েছে। ২০ দশমিক ১৭ শতাংশ জানান, পরিবারই তাদের কটূক্তির ভয়ে বিভিন্ন বিনোদনমূলক কাজে নিয়ে যায় না। আর ১৯ দশমিক ৮৮ শতাংশ উল্লেখ করেছেন, রাজনৈতিক নেতাদের নেতিবাচক দৃষ্টিভক্তির কারণে তারা রাজনীতিতে অংশ নিতে পারেন না।

সর্বশেষ খবর