বুধবার, ২৫ জানুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

টাকার মান কমেছে ২৫ শতাংশ

মানিক মুনতাসির

টাকার মান কমেছে ২৫ শতাংশ

গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে শুরু হওয়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের দামামা কবে থামবে তা কেউ জানে না। এই যুদ্ধের প্রভাবে বেড়ে যাওয়া ডলারের দাম কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এলেও সরবরাহ স্বাভাবিক হয়নি। বরং সংকট আরও বেড়েছে। আমদানি খাতকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ এবং রপ্তানি বৃদ্ধির জোর প্রচেষ্টাতেও ডলারের সরবরাহ বাড়ানো সম্ভব হয়নি। এর ফলে চাহিদা ও জোগানের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে ব্যাপক ঘাটতি। ফলে কয়েক মাসের ব্যবধানে টাকার বিপরীতে প্রতি ডলারের দাম ৮৮ টাকা থেকে বেড়ে ১২৫ টাকায় উঠেছিল। বছর শেষে গতকালও ব্যাংক খাতে প্রতি ডলার বিক্রি হয়েছে ১০৫ থেকে ১০৭ টাকায়। আর খোলাবাজারে প্রতি ডলার গতকালও ১১৫ থেকে ১১৭ টাকায় বিক্রি হয়েছে। অবশ্য কোথাও কোথাও গতকাল প্রতি ডলার ১১১ টাকায়ও বিক্রি হয়েছে বলে জানা গেছে। গত বছর টানা কয়েক মাস ডলারের সরবরাহ বাড়ায় প্রায় প্রতিদিনই ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবুও পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি।বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, এক বছরের ব্যবধানে টাকার মান কমেছে ২৫ শতাংশেরও বেশি। আর বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর সর্বোচ্চ দরের হিসাবে টাকা অবমূল্যায়িত হয়েছে ৩৫ দশমিক ২০ শতাংশ। অন্যদিকে খোলাবাজারে ডলারের দামের হিসাবে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে ৩৭ শতাংশ। যদিও টাকার মান ধরে রাখতে নানা ধরনের কৌশল নিয়েছিল সরকার। এর অংশ হিসেবে সদ্য ঘোষিত মুদ্রানীতিতেও ভোক্তা ঋণের সুদ হার বাড়ানো হয়েছে। একই সঙ্গে ব্যাংক ঋণ ও আমানতের সুদ হারের ক্যাপ তুলে দেওয়া হয়েছে। ডলার খরচ কমাতে আমদানি খাতকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে আরও ছয় মাস আগে থেকেই। আবার একই সময়ে বাড়ানো হয়েছে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম। বিশ্লেষকরা মনে করেন, গ্যাস-বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম বৃদ্ধির বহুমুখী প্রভাব পড়ে জনজীবনে। এর ফলে সবার আগে বাড়ে পরিবহন ভাড়া। আর পরিবহন ভাড়া বাড়লে জীবনযাত্রার সব ক্ষেত্রে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে, যা মূল্যস্ফীতির চাপকে উসকে দেয়। এর আগে গত দুই মাস মূল্যস্ফীতির চাপ সামান্য কমলেও এখনো তা ৮ শতাংশের ওপরেই রয়েছে। এদিকে শাক-সবজিসহ সব ধরনের তরিতরকারি ও জিনিসপত্রের দাম এখনো বাড়তিই রয়েছে। মানুষের দৈনন্দিন ব্যবহার্য জিনিসপত্র, খাদ্যপণ্য, গুঁড়া ও বার সাবানসহ প্রসাধনীর দাম দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। ওষধুপত্রের বাজারেও এমন কোনো আইটেম নেই যার দাম বাড়েনি। এ ছাড়া আগামী মার্চ ও এপ্রিলজুড়ে আসছে রমজান মাস। রোজা ও ঈদে স্বাভাবিকভাবেই মানুষের খরচের ফর্দ অন্য সময়ের তুলনায় লম্বা হয়। ফলে সামনের দিনগুলোয় মূল্যস্ফীতির চাপ আরও বাড়ার আশঙ্কাই করছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। তাঁর মতে, সরকার একদিকে কৃচ্ছ্রতাসাধনের জন্য বারবার নির্দেশনা দিয়ে আসছে অথচ দৈনন্দিন খরচ বাড়িয়ে দিতে বিভিন্ন সেবাপণ্যের দাম বাড়ানো হচ্ছে। খাদ্যপণ্যসহ অন্যান্য জিনিসপত্রের দাম তো আগের মতোই চড়া। উদাহরণস্বরূপ তিনি বলেন, এক কেজি আটার দাম এক বছর আগে যা ছিল তা এখন দ্বিগুণ হয়ে গেছে। সেটা তো কমানোর কোনো উদ্যোগ ঘোষিত মুদ্রানীতিতে নেই। তবে ভোক্তা ঋণের সুদহার বাড়ানো হয়েছে। এতে যদি ভোক্তা ঋণ কিছুটা কমে তাহলে হয়তো সামান্য ইতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। কিন্তু মূল্যস্ফীতি কমাতে হলে সবার আগে মানুষের জীবনযাপনের খরচ কমাতে হবে। অন্যথায় টাকার মান আরও কমতেই থাকবে, যা দেশের অর্থনীতিতে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করবে বলে তিনি মনে করেন। জানা গেছে, তীব্র সংকটের কারণে গত বছর ডলারের বিপরীতে টাকার রেকর্ড অবমূল্যায়ন হয়েছে। অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে লাগামহীনভাবে বেড়েছে ডলারের দাম, কমেছে টাকার মান। গেল বছরের প্রথম দিকে ডলার বাজার স্থিতিশীল থাকলেও মে মাস থেকে চরম অস্থিরতা বিরাজ করে। সেই অস্থিরতা সামান্য কমলেও ডলার সংকট এখনো প্রকট। ফলে ব্যাংকের বাইরে এখনো ১১৫-১১৭ টাকায় ডলার বিক্রি হচ্ছে। এতে টাকার অবমূল্যায়ন ঠেকানো কোনোভাবেই সম্ভব হবে না বলে মনে করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান। তিনি বলেন, ডলারের আয় বাড়াতে হবে। ডলার খরচ কমাতে হবে। একই সঙ্গে মানুষের জীবনধারণের খরচ কমানোর উদ্যোগ নিতে হবে। তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো দেশ থেকে মুদ্রা পাচার বন্ধ করতে হবে। মুদ্রা পাচার বন্ধ হলে ডলার সংকট এমনিতেই কমে আসবে বলে তিনি মনে করেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে গত ১০ বছরের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ২০২০ ও ২০২১ সালে করোনার কারণে ডলারের চাহিদা কম থাকায় এবং বৈদেশিক মুদ্রার আয় বেশি হওয়ার কারণে ২০২০ সালে টাকার মান বেড়েছিল সামান্য। অবশ্য অন্যান্য সময়ে ডলারের দাম বেড়েছে। টাকার মান কমেছে। তার বেশির ভাগই ১ শতাংশের কম থেকে ২ শতাংশের মধ্যেই ছিল। শুধু ২০১৭ সালে টাকার মান কমেছিল পৌঁনে ৫ শতাংশ। আর বিদায়ী (২০২২) বছরে রেকর্ড হারে ২৫ শতাংশ কমেছে টাকার মান, যা সরকারি হিসাব। বেসরকারি বিভিন্ন গবেষণা সংস্থার হিসাবে তো টাকার মান কমেছে ৩৫ থেকে ৩৭ শতাংশ। যার ফলে মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্কের ঘর ছুঁই ছুঁই করেছে অক্টোবর পর্যন্ত। নভেম্বর ও ডিসেম্বরে এসে কিছুটা কমেছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের কাছ থেকে ৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ পেতে সংস্থাটির দেওয়া শর্ত অনুযায়ী মাত্র কয়েক দিন আগে বাড়ানো হয়েছে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম। ফলে সামনের দিনগুলোয় মূল্যস্ফীতির এই চাপ আরও বাড়বে। যার প্রভাবে টাকার মান আরও কমার আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর