বৃহস্পতিবার, ৯ মার্চ, ২০২৩ ০০:০০ টা

মুঘল আমলের দুর্গ

রিয়াজুল ইসলাম, দিনাজপুর

মুঘল আমলের দুর্গ

দিনাজপুরের ঐতিহাসিক মুঘল আমলের ঘোড়াঘাট দুর্গটির অস্তিত্ব আজ বিলীনের পথে। দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলার ওসমানপুর থেকে ৪ কি.মি. দক্ষিণে সাহেবগঞ্জ মৌজায় করতোয়া নদীর তীর ঘেঁষে জরাজীর্ণভাবে দাঁড়িয়ে আছে এক সময়ের রণ হুংকারে গর্জে ওঠা মধ্যযুগের বাংলার বৃহত্তম এ দুর্গ। এখন এখানে গড়ে উঠেছে বসতি। বর্তমানে অস্তিত্বের অংশটি মাজারপাড়া নামে পরিচিত। স্থানীয়রা মনে করেন আগামী প্রজন্ম ও পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় করতে এখনই এর স্মৃতিচিহ্ন রক্ষায় এগিয়ে আসা উচিত।

ঘোড়াঘাট দুর্গের পূর্বদিকে প্রবাহিত করতোয়া নদী এবং পশ্চিম, দক্ষিণ ও উত্তর দিকে (লাগোয়া) পরিখা দ্বারা বেষ্টিত। সুলতানী আমলের আগে এ দুর্গের ভিত প্রতিষ্ঠিত হলেও মুঘল আমলে এর চরম উন্নতিসাধিত হয়। অনেক গবেষকের গ্রন্থে প্রমাণ মেলে উত্তরবঙ্গের মধ্যে এটি একটি মাঝারি ধরনের মাটির দুর্গ ছিল। কার্নিংহামের মতে, ঘোড়াঘাট শহরের আয়তন উত্তর-দক্ষিণে ১০ মাইল ও প্রস্থে ২ মাইল। আ. কা. মো. যাকারিয়ার বাংলাদেশ প্রত্নসম্পদ গ্রন্থের তথ্য মতে, আলোচ্য দুর্গটি উত্তর-দক্ষিণে লম্বা ও পূর্ব-পশ্চিম দেয়ালের দৈর্ঘ্য অনুরূপ, উত্তর দেয়াল আধা মাইল এবং দক্ষিণ দেয়াল প্রায় এক মাইল লম্বা। ধারণা করা হয়, এই সীমানা কেবল দুর্গের কেন্দ্রের। বিশেষ করে দক্ষিণ দিকে আরও প্রলম্বিত ছিল। উত্তর, দক্ষিণ ও পশ্চিম দিকে যে পরিখা দেখা যায় তা প্রায় ৬০ ফুট চওড়া। পশ্চিম দেয়ালের উত্তরাংশে দুর্গের প্রধান প্রবেশ পথ ছিল। প্রবেশ পথ থেকে ৪০০ গজ দক্ষিণ-পূর্ব দিকে দুর্গের দ্বিতীয় আন্তদেয়ালের শুরু। এর পাশেই ছিল ফৌজদার ভবন। তাছাড়াও দুর্গ বেষ্টনীর প্রধান অংশে ছিল প্রশাসনিক ভবন, সেনা ছাউনি, সামরিক কর্মচারীদের বাসভবন, মসজিদ ও মাদরাসা। এখন শুধু পরিখার ওপরে ৮/১০ ফুট উঁচু লালমাটির প্রাচীর আছে যেগুলো পথিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তবে আজ আর নেই এর কোনো অস্তিত্ব। সম্রাট আকবরের আমলে এই দুর্গে ৯০০ অশ্বারোহী, ৫০টি হাতি ও ৩২ হাজার ৬০০ পদাতিক সৈন্যের স্থান সংকুলান হতো। দুর্গের অভ্যন্তরভাগে পশ্চিম দিকে (পাকা সড়কের ধারে) ফৌজদার ভবনের কাছাকাছি জায়গায় একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত মসজিদ, মসজিদের পশ্চিম দিকে পুরাতন জরাজীর্ণ কবর ও মসজিদের সামনে একটি ৮ কোণী ইদারা এবং দক্ষিণ পাশে গোলাকার আর একটি পরিত্যাক্ত ইদারা যা প্রায় ভরাট হয়ে গেছে। এখন বৃক্ষরোপণ করা হয়েছে কিছু। অধুনা এই স্থানটি মাজারপাড়া বলে পরিচিত। দুর্গনগরীর অভ্যন্তরে ধ্বংসপ্রাপ্ত সমজিদটি ঘোড়াঘাট মসজিদ বলে পরিচিত। এর দৈর্ঘ্য ৪৬ ফুট ও প্রস্থ ২২ ফুট। কার্নিস পর্যন্ত উচ্চতা ১৪ ফুট প্রায়। সামনে ৩ দরজা ও ওপরে ৩ গম্বুজ। চারকোণায় ৪টি মিনার ছিল তা নষ্ট হয়ে গেছে অনেক আগে। উত্তর দিকের গম্বুজ ও দেয়াল ভেঙে পড়েছে। দেয়ালের পুরুত্ব ৪০ ইঞ্চির মতো। সমগ্র ইমারতের পলেস্তারা খসে পড়েছে। ভিতরে ৩ কাতার নামাজির স্থান সংকুলান হতো। এক সময় এ মসজিদটি অত্যন্ত সৌন্দর্যমণ্ডিত ছিল। বুকানন হেমিল্টনের দেওয়া তথ্য মতে, আলোচ্য মসজিদটি নবাব আলীবর্দি খানের আমলে ১১৫৩ হিজরিতে (১৭৪০ খ্রি.) মোহাম্মদ হোসেনের পুত্র জয়নাল আবেদীন নির্মাণ করেন। এই জয়নাল আবেদীন ঘোড়াঘাট দুর্গের ফৌজদার ছিলেন। এখানে উল্লেখ্য, দুর্গের দক্ষিণ পূর্ব দিকে আলাউদ্দিন হোসেন শাহর আমলে নির্মিত দ্বিতীয় আরেকটি সমজিদের ধ্বংসাবশেষ চাম্পাতলী থেকে আবিষ্কৃত হয়েছে। ওই মসজিদের শিলালিপিটি বগুড়া জাদুঘরে রক্ষিত আছে বলে বাংলাদেশ প্রত্নসম্পদ গ্রন্থে উল্লেখ আছে। অনেকের ধারণা, সেনানিবাসের মধ্যে থাকা আলোচ্য মসজিদটিতে ফৌজদার ও উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিরা নামাজ আদায় করতেন। মসজিদের সামনে ৮ কোণী (প্রায় ১২ ফুট বেড়) একটি পাকা ইদারা আছে। আবার একই মসজিদের দক্ষিণ পাশে লাগোয়া আরেকটি ইদারা আছে। এটি গোলাকার। এর ওপরের মুখ এখন সমতলভূমি। মুখের ব্যাস প্রায় ৬ ফুট। ধারণা করা হচ্ছে, এই ইদারা দুটির পানি নামাজিদের অজুর জন্য ব্যবহার হতো। এখন পরিত্যক্ত অবস্থায় আছে। ভিতরে পানি নেই, ভরাট হয়ে গেছে ইদারা দুটি। দ্বিতীয় ইদারার পশ্চিম পাশে পাকা সড়কের ধারে মসজিদের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে লাগানো একটি পাকা কবরের অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়। বাঁধানো কবরের কিছু অংশের ইট খুলে পড়েছে। কবরটি কার তা জানা যায়নি। এই কবরের আশপাশে আরও কিছু কবরের অস্তিত্ব বিদ্যমান। তবে সেগুলো মাটির সঙ্গে মিশে গেছে অনেক আগেই। অধুনা স্থানটি ‘মাজারপাড়া’ বলে স্থানীয়দের কাছে পরিচিত। ২০০৮ সালে স্থানটি পরিদর্শনকালে মসজিদের পাশে একটি সাইনবোর্ডে তা লেখা রয়েছে। সেই সঙ্গে জঙ্গলে ঢাকা সমুদয় স্থানটি পরিষ্কার করা হয়েছে। ধ্বংসপ্রাপ্ত মসজিদটি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হওয়া সত্ত্বেও দেশের প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের কোনো সাইনবোর্ড সেখানে দেওয়া হয়নি। দৈনিক শত শত বাসযাত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে এই পরিত্যক্ত ও প্রাচীন নিদর্শনটি। উল্লেখ্য, এ সমাধি থেকে ১ কি.মি. পূর্ব দিকে নদীর ধারে চম্পাতলী নামক স্থানে বাঁধানো ঘাট ও উঁচু একটি ঢিবির অস্তিত্ব দেখা যায়। স্থানীয় বাসিন্দারা এ স্থানকে পুঁথি সাহিত্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গাজী কালু ও চম্পাবতীর স্মৃতিবিজড়িত নিদর্শন বলে মনে করেন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর